আষাঢ়স্য প্রথম দিবস-এ অবতকের বিশেষ প্রতিবেদন

কদম ফুলের বৃষ্টি
তমাল সাহা

আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন/ ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে/ তোমাকে আমার মনে পড়েছে… গানটি কী খুব খারাপ! জানিনা।
তখন বোধ করি এইটে পড়ি। ক্লাসের ভেতর আমরা। ইস্কুলের বাইরে বিশাল কম্পাউন্ড। তখন কম্পাউন্ডে চারটি বিশাল আমগাছ ছিল। এখন কমপাউন্ডের পশ্চিম প্রান্তে একটি আমগাছ রয়েছে।
সে যাই হোক বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। বাংলার মাস্টার মশাই পরিমল ভট্টাচার্য। পরে তিনি আমার এই হোগলা পাতার স্কুল থেকে হারনেট হাইস্কুলে চলে যান। বলেন, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। এই বর্ষা সম্বন্ধে একটা এক পৃষ্ঠার রচনা লেখ্ তো দেখি! তাৎক্ষণিক তোরা কেমন বৃষ্টির রচনা লিখতে পারিস্, দেখি!
আমরা তখন জানতুম রচনায় কোটেশন না দিলে সেটা রচনাই নয়। আমি তো তখন খুব চালু ওই গানের কোটেশন দিয়ে রচনাটা লিখলুম এবং সকলের আগেই জমা দিলুম।
পরিমল স্যার পড়লেন। আমাকে ডাকলেন। টেবিলের সামনে দাঁড় করালেন। বললেন, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক। এই বয়সে– মানে না তো মন-এর তুই কী বুঝিস? তোমাকে আমার মনে পড়েছে! তোমাকেটা- কে, বুঝিস কিছু? গানের লাইনের কোটেশন। আমি আর কী বলি! মুকুল দত্ত লিখেছেন, সেটা তো তার দোষ। আমি শুধু সেটাই কপি করেছি! আমি চুপ। কান ধরে দাঁড়িয়ে রইলুম এক পিরিয়ড, ৪০ মিনিট!

অত ছেলের সামনে পরিমল স্যার জিজ্ঞাসা করছেন, কোন সিনেমার গান জানিস? আমি বলি, হ্যাঁ। মণিহার। গানটা কে লিখেছে, জানিস? মাথা নিচু করে এক নাগাড়ে বলে যাই, মুকুল দত্ত, গেয়েছেন লতাজি, লিপ গিয়েছেন সন্ধ্যা রায় আর সুর করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
স্যার আমার কাছে আসেন আমার মুখটা উঁচু করে ধরে বলেন কারা অভিনয় করেছে জানিস? আমি বলি, হ্যাঁ স্যার, তাও জানি। সৌমিত্র চ্যাটার্জী সন্ধ্যা রায় বিকাশ রায় কমল মিত্র ছায়া দেবী পাহাড়ি সান্যাল রবি ঘোষ বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জী। সব বড় বড় আর্টিস্ট স্যার! আর নির্দেশক সলিল সেন। স্যার আশ্চর্য হয়ে যান। আমি বলি, স্যার এটা এক প্রফেসরকে নিয়ে লেখা গল্প। তুই এত সব জানলি কি করে? স্যার! আমার মা আমাকে বলেছে। মা সিনেমাটা দেখেছে।

স্যার বলেন, তোর তো গার্জিয়ান কল করতে হবে! আমি বলি, স্যার! বাবাকে ডাকবেন না, মাকে ডাকবেন।

এই মা-ই আমার জীবনের যত নষ্টের মূল। এই মা-ই আমাকে বৃষ্টি দেখা শিখিয়েছে পথের পাঁচালীতে। পথের পাঁচালী দেখতে মা আমাকে নিয়ে গেছে সেই হাইন্ডমার্স মাঠে। সেখানে সরকারি গাড়িতে পর্দা লাগিয়ে পথের পাঁচালী দেখানো হয়েছে। সে কী অপূর্ব বৃষ্টিতে ভেজা! অপুর শীত লাগছে। দুর্গা আদুল গায়ে শাড়ির আঁচলে বুকে আঁচল জড়িয়ে গাছের আড়ালে।এই বৃষ্টি থেমে যা। নেবু পাতা, করমচা….

আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন মানে জীবনের প্রথম কদম ফুল। কবরখানার উত্তর-পশ্চিম কোণে দুটি গাছ ছিল। একটি শিমুল গাছ ও অন্যটি কদমগাছ। কদম গাছতলায় একটি গুমটি, চায়ের দোকান ছিল। তার সামনে পাতা বেঞ্চে বসে আড্ডা দিতুম আমরা। আর উত্তর দিকের ছাদের খিলানে বেশ বড় নীল রঙের কৃষ্ণমূর্তির একটা ভাস্কর্যওয়ালা একটা বাড়ি ছিল। আমরা সেই বাড়ির ঝুল বারান্দায় দাঁড়ানো মেয়েদের দেখতুম। তখন ও পাড়ায় গোটা দুই তিনেক দোতলা বাড়ি ছিল। দোতলা বাড়ি মানেই তখন বড়লোক। তার মানে বড়লোকদের বাড়ির মেয়েদের দিকে আমাদের নজর ছিল। বৃষ্টি হচ্ছে জলে ভেজা কদম ফুলের গন্ধ যে পায়নি তার বুকে নিশ্চিত প্রেম নেই।

চিরকুট শব্দটি এখন রাজনৈতিক মাত্রা পেয়ে গিয়েছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চিরকুট কবিতা আছে। চিরকুটের আসল মানে এবং মূল্য শুধু জানে ভালোবাসার মানুষেরা। বর্ষা মানেই ভেজা চিরকুটে চিঠি। তাতে কী লেখা থাকে? না খুলে পড়লেও সকলেই জানে।
ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে যে মেয়েটা হাত পেতে জল বিন্দু নেয়, চিবুকে মাখে অথবা ছাদে চলে যায়, চুল ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখমণ্ডলে বারিবিন্দু গ্রহণ করে, ধারায় ভেজে— এ দৃশ্য যে দেখেনি সে কী পুরুষ হতে পারে!

নীল নবঘনে আকাশ গগনে… রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা বা বর্ষামঙ্গল-এ ফুলের গন্ধ ভরা মাঙ্গলিক কবিতা যে পড়েনি, সে কী যৌবনের গোপন রহস্যের আন্দাজ পায়? বল্ না মেঘমল্লার শব্দটি কেমন লাগে, পর্জন্য মেঘ শব্দটিতে কিসের ব্যঞ্জনা আছে এসব কোনোদিন আমাকে বলেছিল রুমুদি। এ ভরা বাদর মাহ ভাদর– এই সবই রুমুদির শেখানো। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বৃষ্টির বর্ণনা ও কালিদাসের মেঘদূত-এর কথা রুমুদিই আমাকে শুনিয়ে আমার চেতনা অন্য সুরে বেঁধে দিয়েছিল।

রথ যে যুদ্ধ নয়, প্রেমের প্রতীক সে তো আমাদের পড়শি সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই শিখিয়েছে।অসমবয়সী প্রেমের মাধুর্য সে আমাদের শেখায় নি? তাতে কি কোনো অন্যায় অপরাধ হয়েছে? রথযাত্রায় বনফুলের মালা, রাধারাণী ভালোবাসা ছাড়া আর কী? জীবনে প্রেমের আয়োজন সেই তো শিখিয়ে গিয়েছে। পিতৃজনেরা যতই ক্ষুব্ধ হোন ভালোবাসার জোর ও প্রবল টানেই পার্থিব বাধা কাটিয়ে ফাঁসিতে যাওয়া যায়, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে কবিতাকে নিয়ে পালিয়ে রথের মেলা দেখতে যাওয়া যায়, আচার খাওয়া যায়। এতে লুকোচুরি ভালোবাসার অপূর্ব শিহরণ থাকে। রথের মেলায় ফুল ফলের চারাগাছ পাওয়া যায়। আসলে বর্ষার জলে ভিজে গাছে ফুল ফোটে ফল ধরে। এসবই আষাঢ়ে বৃষ্টির বুকে ভালোবাসার সংকেত। রথের মেলায় এসব দেখতে দেখতে কবিতা তো মনসৃজা হয়ে যায়! সে তো একটি বালকও বোঝে, না হলে সে আনন্দে সজোরে তালপাতার ভেঁপু বাজাবে কেন?

বর্ষায় যে বালক ও বন্ধু বালিকা একসঙ্গে স্কুল ফেরার পথে খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে বানানো কাগজের নৌকো হাত ছোঁয়াছুঁয়ি করে হাঁটুডোবা জলে ভাসায়নি আর পরস্পরের ভেজা মুখের দিকে তাকায়নি, তা হতে পারে? তাকিয়েছে, তখনই তো তারা আকাশকে বড় করে দেখা শিখেছে।

বৃষ্টিতে ভিজে বারুদ নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তবে বৃষ্টিতে ভিজলে হৃদয়ের উষ্ণতা বেড়ে যায় কেন কে জানে? ডারউইন কী জানে?
বৃষ্টিভেজা অবয়বে যে ওষ্ঠ স্থাপন করেনি সে কি করে জানবে চুম্বনের স্বাদ!