অন্যরকম লিখিঃআজ মহান বিজ্ঞানীর মৃত্যুদিন

অর্ধেক আকাশ ছাড়া পুরুষ কি বাঁচে?

মিলেভা মেরিক ছাড়া আইনস্টাইন কী আইনস্টাইন হতে পারতেন?
তমাল সাহা

আইনস্টাইন মানে কী? ব্রেইনিয়ান, প্রতিভা। আলবার্ট মানেই বা কী? সফল। আইনস্টাইনকে তো সকলেই চেনেন, মিলেভা মেরিককে কজন জানেন ?

পৃথিবীর ইতিহাসে আইনস্টাইন একটি ঘটনা বহুল মানুষ। চিন্তা চেতনা মেধা প্রজ্ঞায় সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ। আপেক্ষিকতাবাদ, ই ইকুয়াল টু এম সি স্কোয়ার কত সব বৈজ্ঞানিক কাণ্ডকারখানা! ফ্যাসিবাদ বিরোধী মানুষ। জন্মভূমি থেকে পলাতক, নির্বাসিত জীবন। এ সবই জ্ঞানচক্ষু মেলে দেবার কথা।

কিন্তু দুঃসময়ে মানুষটির ঘরোয়া জীবন, তার সঙ্গে অর্ধেক আকাশের দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ মিলেমিশে একাকার। বেহালা বাজাতে জানতেন তিনি। চুটিয়ে ভালবাসতে জানতেন। পরকীয়া প্রেমেও আহ্লাদ ছিল। তিনি বলেছিলেন জীবন একটা সাইকেলের মতো। ভারসাম্য রাখতে হলে সেটাকে চালাতে হয়। আইনস্টাইন গেরস্তালি জীবনে সত্যিই কী ভারসাম্য রাখতে পেরেছিলেন?

অনেকেই বলেন তিনি জ্ঞানের আধার যেমন ছিলেন একগুঁয়েও ছিলেন। বিশেষ করে মায়ের অমতেই তো বিয়ে করেছিলেন মিলেভা মেরিককে‌। মিলেভা সুন্দরী তো ছিলেনই না, উপরন্তু পায়ে খুঁত ছিল, খুঁড়িয়ে চলতেন। তবে তাকে বিয়ে করলেন কেন আইনস্টাইন? আইনস্টাইনের বয়স তখন ১৯,মিলেভার বয়স ২৩। তাই কী? মিলেভা তো অর্ধেক আকাশ হবার যোগ্যই ছিল। তিনি ছিলেন গণিত বিশেষজ্ঞ এবং পদার্থবিদ। জুরিখ ইন্সটিটিউশনে পড়ার সময়কার সহপাঠী। জুটি তো ভালোই। আইনস্টাইন নিজেই স্বীকার করেছিলেন, এমন নারী কজনার ভাগ্যেই বা জোটে!
আইনস্টাইনের গবেষণা জগতে মিলেভার কী কোনো কম ভূমিকা ছিল? না থাকলে আইনস্টাইন আইনস্টাইন হতেই পারতেন না। তার গবেষণালব্ধ কাগজপত্র, সন্দর্ভ,আপেক্ষিকতাবাদ যতসব যুগান্তকারী আবিষ্কার কোথায় পেত দুনিয়া? এসব কর্মকাণ্ডের সহযোদ্ধা ছিলেন মিলেভা।কিন্তু এর পরিবর্তে আইনস্টাইনের কাছ থেকে কী পেয়েছিলেন তার একসময়ের অর্ধেক আকাশ মিলেভা মেরিক?

কী দেয়নি আইস্টাইনকে মিলেভা? বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেই কি ভালোবাসা প্রগাঢ়তর হয়? বিয়ের আগেই তো জনক জননী হয়ে গিয়েছিলেন আইনস্টাইন ও মিলেভা। কন্যা সন্তান লিজারেলকে জন্ম দিয়েছিলেন তারা। তখন ওই রক্ষণশীল ব্যবস্থায় এটা অন্যায় অপরাধ ছিল, সামাজিক কলঙ্ক ছিল।
তাহলে আইনস্টাইনের আবিষ্কারের পেছনে, নোবেল জয়ের পেছনে এই তথাকথিত গোপন অবৈধ ভালোবাসার কী কোনো প্রাধান্য ছিল না? গবেষণা আবিষ্কার পুরস্কার যশ খ্যাতি অর্জনে অর্ধেক আকাশের ভূমিকা নেই, নেই নারীত্বের গুরুত্ব, নেই মিলেভার আত্মত্যাগ?
কম প্রতিভাশীল ছিলেন না মিলেভা। তিনিও তো পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আইনস্টাইনকে গুরুত্ব দিতে, তার খ্যাতি অর্জনের স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন মিলেভা। মিলেভা শিক্ষার জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন কিসের আনন্দে? নিশ্চিত পুরুষতন্ত্রের জয়ে তিনি হৃদয়ে আশ্চর্য অনুভবে অনুরণিত হয়েছিলেন। আইনস্টাইনের মন চিন্তা চেতনা গবেষণায় নিবিষ্ট। তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন জাতক জাতিকাকে সামলেছেন, মানুষ করেছেন, ঘরদোর সাফসুতরো রেখেছেন, গৃহস্থালি কাজকর্মের দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন।কিন্তু আইনস্টাইনের চোখে তিনি শেষ পর্যন্ত অসহনীয় হয়ে উঠেছিলেন।

আইনস্টাইন প্রেমে পড়ে গেলেন এলসার সাথে। কে এলসা? তার কাজিন এলসা তখন অন্য পুরুষের দুই কন্যা সন্তানের মাতা। আইনস্টাইন কেমন যেন নিষ্ঠুর হয়ে উঠলেন। আইনস্টাইনের বইপত্র, গবেষণার কাগজ, পোশাক আশাক আর ছুঁতে পারতেন না মিলেভা। নিজের ইচ্ছায় আইনস্টাইনের সান্নিধ্য পেতেন না। আইনস্টাইনের কথা শুনতেই সে বাধ্য হত। পাল্টা কথা বলার তার অধিকার ছিল না। এরই মধ্যে আবার আইনস্টাইন তৃতীয় প্রেমে পড়ে গেলেন মেরি নামে এক নারীর সাথে। উপেক্ষিত অপমানিত মিলেভা বাধ্য হলেন আইনস্টাইনের ঔরসজাত প্রিয় প্রজন্মদের নিয়ে ঘর ছাড়তে, চলে গেলেন সুইজারল্যান্ড।

কেন এমন হয়? ১৯০৩ সালে মিলেভার সান্নিধ্যে এসেছিলেন। বিচ্ছেদ হয়ে গেল ১৯১৯ সালে।

আইনস্টাইন মহান মানুষ‌ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বর্ণবাদ শ্বেতাঙ্গ মানুষের ব্যাধি। তিনি বলেছিলেন, আমার প্রিয় বিজ্ঞানী নিউটন। তিনি বলেছিলেন, আমার প্রিয় বন্ধু রবীন্দ্রনাথ।
১৯৩১ সাল। চার্লি চ্যাপলিনের সিটি লাইটসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। দুজনের সাক্ষাৎকারে কী কথা হয়েছিল! আইনস্টাইন বলেন, আপনি এত বড় শিল্পী, আপনি একটি শব্দ উচ্চারণ করেন না অথচ সারা পৃথিবীর মানুষ সব বুঝে যায়! পাল্টা জবাবে চ্যাপলিন বলেছিলেন, আপনার ক্ষমতা আমার চেয়েও বেশি। আপনার বিজ্ঞান কেউ বুঝতে পারে না অথচ সারা পৃথিবীর মানুষ আপনাকে পছন্দ করে।

জীবনের অর্ধেক আকাশ মিলেভার প্রাণময় ভালোবাসা যদি না পেতেন আইনস্টাইন আজ কোথায় থাকতেন!

আজ আলবার্ট আইনস্টাইনের মৃত্যুদিন। দুনিয়ার এইসব নারীদের প্রতি আমার বিস্তৃত ভালোবাসা, তাদের পায়ের পাতার দিকে আমি মাথা নিচু করে থাকি‌। আমি যে নারী-প্রকৃতি বড় ভালোবাসি।