অবতক খবর , অভিষেক দাস , মালদা :- দিনকয়েক পরই দীপাবলি।আলোর দ্বীপ জ্বালিয়ে বাঙালী প্রস্তুত দেবীর আরেক রূপের আরোধনাই।প্রাচীনত্ব,ঐতিহ্যের দিক থেকে মালদার গোবরজনা কালীপূজা জেলার প্রথম সারিতেই স্থান।জেলাবাসীর কাছে ‘গোবরজনা কালীপূজা’ নামে পরিচিত এই কালী পুজো। জেলার অন্যতম ঐতিহ্যপূর্ণ কালীপূজা এটি।

 

মালদা সদর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে পুখুরিয়া থানার অন্তগর্ত আরাইডাঙ্গা গ্রামপঞ্চায়তের অন্তর্গত গোবরজনা গ্রাম।সেখানেই অবস্থিত মায়ের স্থাপিত কালিমন্দির। প্রতিবছর ভক্তি নিষ্ঠার সাথে পূজা হয়ে আসছে। প্রতিবছর রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষাধিক ভক্তেরা এই পুজোয় ভিড় জমায়।মায়ের মন্দির সংলগ্ন কালিদ্রি নদীর তীরে বিশাল মেলা বসে পূজার কটা দিন।তবে এবছর করোনা আবহে পূজো পরিচালনাতে সমস্ত রকম প্রশাসনিক নির্দেশিকা সাথে মেলা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

 

এলাকার প্রবীণদের মুখে জানাযায়,গোবরজনা কালীপূজা ডাকাতদের হাতে সৃষ্টি।ডাকাতেরা শক্তির আরোধনাই মা কালীর পুজো এলাকায় আরম্ভ করে।প্রায় ৩৫০ বছর ধরে এই ডাকাতের হাতে সৃষ্ট এই পুজো আজও একই রীতি,নীতি,মেনে হয়ে আসছে।পুখুরিয়া,আরাইডাঙ্গা এলাকায় সমগ্র এলাকা ঘনজঙ্গলে ঢাকা ছিল।সেসময় ঘনজঙ্গলে হিংস্র পশুও বাস করতো।তাই মানুষের আনাগোনাও এলাকায় কম ছিল।সেই সুযোগে বিহার থেকে একদল রাজপুত নদীপথে এসে এই জায়গায় বসবাস শুরু করে। এই রাজপুত মানুষদের পেশায় ছিল ডাকাতি করা।এখান থেকেই বিভিন্ন প্রান্তে ডাকাতি চালাতো।ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে ও ডাকাতি করে ফিরে এসে শক্তির আরোধনার জন্য মা কালীর পুজো করতেন ডাকাতরা।কার্তিক মাসে ডাকাতেরা নিজেরাই মায়ের প্রতিমা তৈরি করে পুজো করতো।আর এই থেকেই পুজো একই মতো হয়ে আসছে।

বর্তমানে নেই জঙ্গল,নেই ডাকাত।গড়ে উঠেছে ছোট ছোট গ্রাম।এলাকার এক চৌধুরী পরিবার বংশপরম্পরায় এই পুজো চালিয়ে আসছে।স্থানীয় জ্যোতিষ চৌধুরীর পরিবারের বংশধররা বর্তমানে এই পুজোর দায়িত্ব থাকলেও এলাকাবাসী ও পুলিশ প্রশাসন সমগ্র দায়িত্ব ভার সামলে থাকেন। এই পুজোতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহযোগিতা করে এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন। পুজোর কটা দিন মায়ের আরাধনা মত্ত থাকে গোটা এলাকা।বর্তমানে জ্যোতিষ চৌধুরীর পৌত্ররা বংশ পালা করে এই পুজো পরিচালনা করে আসছে।চৌধুরী প্রতিবারের দানের দেড় বিঘা জমির উপর মায়ের স্থাপিত মন্দির রয়েছে।এই পুজো নিয়ে এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়,সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবী চৌথুরানী উপন্যাসের নায়ক ভবানী পাঠক ও দেবী চৌথুরানীর স্মৃতি রয়েছে এই পুজোয়।কথিত আছে সেসময় ভবানী পাঠক ও দেবী চৌথুরানী বজরা করে রাতে নদীপথে উত্তরবঙ্গের দিকে যাওয়ার পথে নদীতে বজরা আটকে পোড়ায় এই গোবরজনা কালি মন্দিরে রাত যাপন করেছিলেন।

তারপর মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে মায়ের পুজো দিয়েছিলেন তারা।তারপর তাদের বজরা চলতে আরম্ভ করে।তবে এখনো এই পুজোকে ভবানী পাঠকের পুজো বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন অনেকেই।আবার কেউ তা মানতে নারাজ।কারণ,গল্পের নায়ক বাস্তবে কি করে আসবে।তবে যত দিন যাচ্ছে এই পুজো ও মায়ের প্রতি বিশ্বাস বেড়েই চলেছে ভক্তের।বিহার,ঝাড়খন্ড এমনকি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে মায়ের পুজো দিয়ে ভিড় জমায় এই মন্দিরে।প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার পাঠা বলি হয় এই মায়ের কাছে। বছরের প্রত্যেক মঙ্গল ও শনিবার ভক্তের সমাগম হয়নি মন্দির প্রাঙ্গণে। প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালিন্দ্রি নদীতে মায়ের প্রতিমা বিসর্জন করা হয় পুজোর পরে দিনই।তবে এই বছর অতিমারি করোনার দাপট রয়েছে। উৎসব পালনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক নির্দেশিকা রয়েছে। যদিও কোনরকম ভিড় জাতের না জমে সেদিকে তৎপর থাকছে প্রশাসন এমনটাই জানা গেছে। সাথে পুজো ঘিরে সতর্কতা মেলা ক্ষেত্রেও এখনো সংশয় রয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রশাসনিক কর্তারা আলোচনার মধ্য দিয়ে সমগ্র দিক নির্ধারণ করবেন বলে জানিয়েছেন তারা।

চৌধুরী পরিবারের এক সদস্য শান্তি চৌধুরী জানান,”জেলার প্রাচীন ও শ্রেষ্ঠ পুজোর মধ্যে অন্যতম এই পুজো।এলাকাবাসী ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় এই পুজো,মেলা,বলি,নিরঞ্জন সমগ্রই শান্তিপূর্ণ সম্পন্ন হয়ে থাকে। যথাযথ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন।মায়ের প্রচুর অলংকার রয়েছে।পুজোয় প্রচুর দান করে মানুষ।তাই পুজোর বাজেটে অসুবিধে হয়না।প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই একই মতো পুজো হয়ে আসছে আজও। তবে এ বছর একটু আলাদা পরিস্থিতি রয়েছে। তাই মন্দির প্রাঙ্গণে মাছ স্যানিটাইজার সর্বত্র সর্তকতা অবলম্বন এর উদ্যোগ রয়েছে।এত বড় পুজো সাথে মেলা তাই পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে এই পুজোকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয় গোটা এলাকাকে।