কাঁচরাপাড়া কলেজের সুবর্ণ জয়ন্তীঃ অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন

কাঁচরাপাড়া কলেজের সুবর্ণ জয়ন্তী ও বীজপুরবাসী

তমাল সাহা

কাঁচরাপাড়া কলেজের জন্ম এক সংগ্রামী ইতিহাস। এটির উদ্বোধন করেন স্বনামখ্যাত মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ১০ নভেম্বর ১৯৭২। ৭০ দশকের সেই সন্ত্রাস জনিত কাল এই ১৯৭২।

আজ এই কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী। জনগণের কলেজ এই কলেজটি পত্তনের ইতিহাস ক্ষেত্রজ গবেষণার বিষয় তো বটেই এক লড়াকু ইতিহাস। বিজপুরবাসীর অহংকার এই কারণে যে এই কলেজটিতে সোজাসুজি জনগণের সংযোগ রয়েছে। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থ অনুদানের সংযোগ রয়েছে এই কলেজ স্থাপনে। প্রারম্ভিক পর্বে কাঁচরাপাড়া হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুখেন্দু বিকাশ চক্রবর্তীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। কারণ এই কলেজটির সূচনা হয় কাঁচরাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে।

আজ কলেজ ক্যাম্পাসে ভূমিপুত্র যুগ সন্ধিক্ষণের কবি এবং বাংলা সংবাদপত্রের জনক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের আবক্ষ মূর্তির উন্মোচন করেন বীজপুর বিধায়ক সুবোধ অধিকারী। বর্ণপরিচয়ের স্রষ্টা এবং বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক শিক্ষাবিদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরেরও একটি আবক্ষ মূর্তির উন্মোচন করা হবে এই উৎসব চলাকালীন অন্য কোনোদিন এমনই জানা গিয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ ও নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আপক্ষমূর্তিও উন্মোচন করা হবে তাঁদের জন্মদিনে এও সূত্রের খবর।

এদিন একটি বিশাল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা করা হয়।

শোভাযাত্রাটি বাগমোড় সুভাষ ময়দান প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে রাণী রাসমনির মূর্তির পাদদেশ ছুঁয়ে কাঁচরাপাড়া গান্ধী মোড় পরিক্রমা করে। কলেজ প্রাঙ্গণে শোভাযাত্রার সমাপ্তি ঘটে।

শোভাযাত্রায় কলেজের শতাধিক অধ্যাপক, অশিক্ষক কর্মী ও প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী সব মিলিয়ে হাজারের উপর মানুষ অংশগ্রহণ করেন বলে জানা যায়। শোভাযাত্রার পুরোভাগে থাকেন অধ্যক্ষ ডঃ প্রণব বেরা এবং কলেজের পরিচিত অধ্যাপকবৃন্দ।

মিছিলের সামনের ব্যানারে লেখা ছিল ‘বর্ণাঢ্য প্রগতিশীল সৃজনশীল শোভাযাত্রা’। এই শোভাযাত্রায় বিবেকানন্দ ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দুটি জীবন্ত মডেল চলমান ছিল।

সূচনা পর্বের অনুষ্ঠানে কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি অঞ্জন রায়চৌধুরী, ছাত্রনেতা তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য, হালিশহর পৌরসভার উপ পৌরপ্রধান শুভঙ্কর ঘোষ, একসময়ের ছাত্রনেতা দীপন দত্ত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এদিন কাঁচরাপাড়া এবং হালিশহরের কাউন্সিলরদের ও সুধীজনদের স্মারক ও রিস্ট ওয়াচ দিয়ে সংবর্ধিত করা হয়।

কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বীজপুর প্রাক্তন বিধায়ক বর্ষীয়ান জগদীশচন্দ্র দাসকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয় কলেজের পক্ষ থেকে।

১১ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উপস্থিত থাকবেন গায়ক শিলাজিৎ ও ফকিরা ব্যান্ড ।

উল্লেখ্য এই অনুষ্ঠান সূচিতে শিক্ষামূলক কোনো আলোচনা বা সেমিনারের অন্তর্ভুক্তি দেখা গেল না। এই কলেজের সঙ্গে প্রতিষ্ঠাপর্ব থেকেই বিভিন্নভাবে যুক্ত এমন কোনো সুধীজনকে আজকের অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি এবং জানা গেছে তারা কোনো আমন্ত্রণ পত্রই পাননি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তবে জানা গেছে অঞ্চলে কুড়ি বছরেরও অধিক কাল ধরে যে প্রতিষ্ঠানটি ঈশ্বরগুপ্ত সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চলেছে, কাঁচরাপাড়ার জনজীবনকে ঈশ্বর গুপ্ত বিষয়ে সজীব রেখেছে সেই প্রতিষ্ঠান ঈশ্বর গুপ্ত পরিষদকে কোনো আমন্ত্রণই জানানো হয়নি।

কাঁচরাপাড়ার শিক্ষা জীবনে কাঁচরাপাড়া কলেজ এক ইতিহাস। আজকের এই প্রকাশ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা না হলে অঞ্চল অধিবাসীরা জানতেই পারতেন না কাঁচরাপাড়া কলেজে এবছর সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পণ করেছে।

উদ্বাস্তু অধ্যুষিত কাঁচরাপাড়ায় ষাটের দশক থেকেই একটি কলেজ নির্মাণের প্রয়োজন অনুভব করতে থাকেন শিক্ষানুরাগী মহল। এই শিক্ষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন সুখেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী, নকুল সুর, বিজয় বসন্ত নন্দী, অমূল্য উকিলের মতো সমাজকর্মীরা। এই কলেজের প্রাথমিক পর্যায় শুরু হয় কাঁচরাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ের এনসিসি-র অফিস ঘর এবং পার্শ্ববর্তী দুটি কক্ষ নিয়ে নাইট কলেজের সূচনা হয়। এই সময়ে কলেজের ইনচার্জ ছিলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুখেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী।

১৯৭০-৭১ সাল সময়কালে ব্র্যাডলে রোডে ডঃ নকুল সুরের বাড়িতে কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য কলেজ অ্যাডহক কমিটি গঠিত হয়। সুখেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী এই কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই কমিটি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য করুণাকেতন সেনের কাছে কলেজ অনুমোদনের জন্য আবেদন করে। পরবর্তীতে এই কমিটির প্রতিনিধিরা শিক্ষামন্ত্রী মৃত্যুঞ্জয় বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং তা ফলপ্রসু হয়। ডেপুটি স্পিকার হরিদাস মিত্রের উদ্যোগে বিধানসভায় এক বিশেষ অর্ডিন্যান্স জারি করে কাঁচরাপাড়া কলেজের অনুমোদনের ভার কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর অর্পণ করে।

উল্লেখ্য কলেজ ভবন নির্মাণের জমিটির প্রকৃত স্বত্বাধিকারী ছিলেন মান্ধারী মিস্ত্রিরা। কাঁচরাপাড়া কবিগুরু রবীন্দ্রপথে তাদের বাড়িটি এখনো ব্রিটিশ কালের ঐতিহ্যবাহী। কাঁচরাপাড়ায় শিক্ষা প্রসারের আন্দোলনে মান্ধারী মিস্ত্রিদের অগ্রণী ভূমিকা অনস্বীকার্য।

কলেজভবন নির্মাণের জন্য সরকারি অর্থ বিলম্বের কারণে গণ আন্দোলন গড়ে তোলা হয় এবং জন অনুদান গ্রহণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেই সময় কাঁচরাপাড়ার কর্পূর শেঠ ১ লক্ষ ইট, হালিশহরের দেবেন্দ্র কুন্ডু বালি এবং পাল অ্যান্ড শর্মা টিম্বার শ্রেণীকক্ষের জন্য সমস্ত দরজা জানালা কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। সেই সময় বিধায়ক হিসেবে শিক্ষক জগদীশচন্দ্র দাস যথার্থ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭৫ সালে ডক্টর এন সি নন্দী প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন ও রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য হন প্রথম উপাধ্যক্ষ। ১৯৯৮ সালে শিক্ষা মন্ত্রী সত্যসাধন চক্রবর্তী কলেজের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ‌