এই গাঙ্গেয় উপত্যকায় মহীনের ঘোড়াগুলি একদিন জোৎস্নায় চরে বেরিয়েছিল প্রান্তরে। একটি মহীনের ঘোড়া চলে গেল রবিবার সকালে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে। চলে গেল বাপি দা– তাপস দাস

এইসব ঘোড়ারা কী মরে যায়
তমাল সাহা

সত্যিই কি মহীনের ঘোড়ারা মরে যায়? ঘোড়ারা পুরানো বাতিল হলেও দৌড়ের রেশটি থেকে যায়। কোন ঘোড়াটি জিতল এমন কিছু আমার মনে হয় না, আমার কাছে থেকে যায় শুধু দৌড়ের রেশ মেজাজ তীব্রতা এবং উত্তেজনা।
এসব নিয়ে সত্যিই কি কোনো ছবি আঁকা যায় ? শুধু তেজী জেদি দৌড়টি খেলা করতে থাকে হৃদয়ের উপত্যকা জুড়ে আর অশ্বক্ষুরের শব্দ ধ্বনিত হতে থাকে বুকের চত্বরে।

মহীন ছাড়া কি অন্য কোনো নাম ছিল না পৃথিবীর প্রান্তরে? মহীন চলে গেলেও আস্তাবলে ঘোড়ারাও একের পর এক মরে যায় কিন্তু ঘোড়াদের গানের সুর স্থায়িত্বের দিকেই হাঁটতে থাকে।

মহীন শব্দের অর্থ কি? মহা যুক্ত ঈন– মহীন! মহীন তো শুনি উজ্জ্বল আকর্ষণীয় আধারে থাকে।

মহীনের তো সাতটি ঘোড়া ছিল গৌতম চট্টোপাধ্যায় (মনি,) রঞ্জন ঘোষাল, তাপস দাস (বাপি), প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়( বুলা), বন্দ্যোপাধ্যায় (ভানু) ,বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, আব্রাহাম মজুমদার।
মহীন বোধ করি জীবনানন্দের সাথেই চলে গেছে। রেখে গেছে আস্তাবলটি। একে একে ঘোড়াগুলি চলে যেতে থাকে আকাশের অভিমুখে চাঁদের দিকে মুখ উঁচিয়ে।
আসলে সময়ের সারথি ছিল মহীনের ঘোড়াগুলি। প্রকৃতির গান, ভালোবাসার গান, দিন বদলের গানের একটা সরণি নির্মাণের গবেষণায় মত্ত ছিল।

৭০ দশকের বজ্রগর্ভবাহী সময় যদি না হাজির হত আস্তাবল থেকে ঘোড়াগুলি কি গান গেয়ে উঠতো? তারা কি জোৎস্নার চত্বরে এভাবে গানের স্বরলিপি লিখতে পারতো?

৭০ দশকে এরা কি রেডিকেল বামপন্থী ছিল? নকশালপন্থী ছিল? তখন তো এমন উচ্চারণ নিশ্চিত ছিল, ‘ও শালা! নকশাল, নকশালাইট! ওকে এড়িয়ে চলো।’
এদের অন্যতম সহিস গৌতমের হাজতবাসও হয়েছিল।
নকশাল রাজনীতি ও জেলখানাকে পরিপূরক করে গড়ে উঠেছিল একটি নয়া দল– মহীনের ঘোড়াগুলি। তেজী ঘোড়ারা উড়িয়ে দিয়েছিল গানের নিশান।

তো মহীনের আরও একটি ঘোড়া চলে গেল রবিবার সকালে, দিনটি ছিল ২৫ জুন ২০২৩।
ঘোড়ার বুকে কর্কট রোগ হয়েছিল। ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। অশ্ববক্ষে ক্যান্সার! কেন?গান হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় বলে!

কেমন গান গাইতো মহীনের ঘোড়ারা? রক ব্যান্ড তো গাঙ্গেয় প্রান্তরে তারাই প্রথম তৈরি করেছিল, ভিত্তিপ্রস্তরের ইট তারাই তো বয়ে এনেছিল।

এই ব্যান্ডটিকে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় লোকসংগীত রক ব্যান্ড। গানের নতুন কথা সৃষ্টিতে ঘোড়াগুলি অন্য মাত্রা যোগ করেছিল।

তাদের সুরধ্বনি ছিল–

পৃথিবী নাকি ছোট্ট হতে হতে…

আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি …
শুধু অজানা লাল সুরকি পথ শূন্যে দেয় পাড়ি

আমি ডান দিকে রইনা /আমি বাম দিকে রইনা/ আমি দুদিকেতেই রই /পরান জলাঞ্জলি দিয়া

আশায় আশায় বসে আছি/ ওরে আমার মন /
কখন তোমার আসবে টেলিফোন

কাঁপে কাঁপে আমার হিয়া কাঁপে
এ কি যে কাণ্ড, সব পণ্ড, এ ব্রহ্মাণ্ড শূন্য লাগে
তুমি ছাড়া শূন্য লাগে

বাঙালি করেছে ভগবান রে

ও গঙ্গা
তুমি চলেছ ঢেউয়ে ঢেউয়ে কোথায়

আমি গাই ঘরে ফেরার গান…/
ফিরব বললেই ফেরা যাই নাকি!

মহীন, মহীনের ঘোড়া জীবনের গতিযান!