আজ মে-ডে

কালকের না-ফোটা কুড়িগুলি আজ ফুটল, শিমুল গাছটাকে আরক্তিম করে তুলল
তমাল সাহা

দগ্ধ দিন। চরম আক্রোশে সূর্য নেমেছে ময়দানে। দুরন্ত আলোকিত ঝলসানো প্রহরে মদনপুর-শিমুরালি থেকে মাসিরা সবজির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে ট্রেন থেকে নামে। তারপর দরদর করে ঘামঝরছে কপাল থেকে গাল বেয়ে এমন মুখ নিয়ে মণ্ডলবাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায়। এদিকে ‘দ্যাখ কেমন লাগে’ বলে’ শিবপুকুর পারে শিমুল গাছের গতকালের অফোটা কুঁড়িগুলি আজ ফুটে গাছের মাথাকে আরও উজ্জ্বল রক্তিমাভ করে ফেলেছে। বিশাল দাপটে রঙ ছড়িয়ে সূর্যকে আজ সে শাসায়। বলে, ঠায় রোদে দাঁড়িয়ে আছি। আয়,দেখি কত বড় তোর মস্তানি! আমার শরীর থেকে বার কর দেখি এক ফোঁটা ঘাম!

গাছ আর সূর্যের এই চ্যালেঞ্জের কথা শুনতে শুনতে আমি মান্ধারী বাজারের রাস্তা ধরে কবিগুরু রবীন্দ্র পথে চলে আসি। ওয়ার্কশপ রোভ ধরে থানা মোড় পেরিয়ে রেল কারখানার লোকো শপ গেটে একটি ম্যাড়মেড়ে জমায়েত দেখি। কিছু শ্রমিকের হাতে লাল ঝাণ্ডা। তারা স্লোগান তুলে আওয়াজ দিচ্ছে, মে দিবস জিন্দাবাদ! দুনিয়ার মজদুর এক হো! এই ধ্বনি শুনে বাতাস কিছুটা থমকে দাঁড়ায়। রাস্তার ওপারে মাখনের চায়ের দোকানের পাশে কিছু শ্রমিক-কেরানি চায়ের কাপ হাতে আগেকার হারিয়ে যাওয়া মে দিবস নিয়ে আফশোসমূলক আলোচনা করতে থাকে।

এই খরতপ্ত দুপুরে আমি একটি টোটো করে চলে আসি ভাগীরথী তীরে, কামগার মহল্লা বলে যে অঞ্চলের পরিচিতি আছে সেখানে।
গতকাল প্রচণ্ড গরমে কাহিল হয়ে নৈহাটি জুট মিলে এক মজুর মারা গিয়েছে। বঙ্গোপসাগরীয় উপত্যকায় এখন দুয়ারে শব্দ যোগে নতুন নতুন সব প্রকল্প রচনা হচ্ছে। এখানে দুয়ারে মৃত্যু নিয়ে রাত্রি নামে। আমি মৃত্যুর সংবাদ লিখি। কেননা মিডিয়ায় এত মৃত্যু, নিরন্নের কাহিনী, দারিদ্র্যের উপাখ্যান ছাপানোর জন্য স্থানের সংকুলান নেই।
মজদুরের মৃতদেহ পড়ে আছে মিলের ভেতর। রাজনৈতিক নেতা, ট্রেড ইউনিয়ন দাদাদের সঙ্গে মালিকপক্ষের উপস্থিতি দেখি।
দুর্ভাগ্যজনক মর্মান্তিক শব্দ দুটি প্রতিফলিত হয়ে চিমনির গা বেয়ে বুঝি আকাশের দিকে চলে যায়। ফিসফাস আলোচনা শুনি। ‘ত্রিপাক্ষিক_ নামে জাতহারামি বৈঠকের মানে বুঝে ফেলি।

আমি শুধু মৃত্যুর খবর জানি। কীটনাশক,দড়ি, রেল লাইন– এখন আমার গবেষণার বস্তূ। মৃত্যুর এইসব সহজ ও দ্রুত উপায়গুলি কী করে জেনে যায় অশিক্ষিত কালিঝুলিমাখা কামগার! আমি জানতে চেষ্টা করি।

শ্মশানঘাটে মৃতদেহ নিতে নিতে সন্ধ্যা নেমে আসে। ওপারে ডানলপ ঘাটের কাছে উধাও হয়ে যাওয়া টায়ার ফ্যাক্টরির ভাঙা চিমনির মাথায় দুই-একটা নক্ষত্র ঝরে পড়ে।
আমি লেনিনের ভ্যানগার্ডকে দেখি। গৌরীপুর জুটমিলের হরেন মণ্ডল বদলির কাম হারিয়ে শেয়ালদা ট্রেনের কামরায় দাদের মলম বিক্রি করে। হাওড়া-খড়গপুর লাইনে কানোরিয়া জুট মিলের কামহীন খগেন মহান্ত মুড়ি-ঘুগনি বিক্রি করে।

লেনিনের ভ্যানগার্ড এখন হকার। হকার কেন? পেটে ভাত নেই। তাহলে কি আছে? খিদে আছে। খিদেতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-বন্ধু-প্রেমিকা ছেড়ে দেওয়া যায়। খিদে ত্যাগ করা যায় না। কারণ তা পেটের সঙ্গে ঘোরে। আমি ঘুরি তো পেট ঘোরে। পেট ঘোরে তো খিদে বাড়ে। খিদে তাড়ানোর একটি উপায় আছে। তা হলো আত্মহত্যা।

সব শ্রমিক কি আত্মহত্যা করে? না। সব শ্রমিক পালায় না। হে মার্কেটের ঐতিহ্যবাহী শ্রমিক পালায় না। তাই সে আবার ঘাম ঝরাতে থাকে।
আমি দেখি হুকুম চাঁদ জুট মিলের ভাগোয়ালা আনসার আলি সাইকেল করে ধূপকাঠি, ফিনাইল সঙ্গে চানাচুর ডালমুট ফেরি করে। নদীয়া জুটমিলের ফজলু মিঞা ভ্যানরিক্সা করে বাড়ি বাড়ি ‘সবজি নেবেন’ বলে হাঁক পারে। ভিক্টোরিয়া মিলের জান মোহাম্মদ হয়ে গিয়েছে রিক্সাওয়ালা। রিলায়েন্স জুট মিলের সদানন্দ, মনিরুল, ইসমাইল রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে হয়ে আবাসন বানায় বারাকপুরে। সঞ্জীব পাশোয়ান, মোসলেম আলিরা এখন ভোরে উঠে মুটেগিরি করে লরি থেকে মাল খালাস করে মাল নিয়ে যায় মোতি বাজারে। ওয়েভারলি মিলের কালি সর্দার দিনমজুর হয়ে যায়। সারাদিন কাজ হয় না। কাম না পেলে দিনভর এদিক ওদিক ঘুরে রাত্তিরে বাড়ি ফিরে মুড়ি আর জল খেয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুম কি আসে? খালি পেটে খিদে গুমরে গুমরে তাকে ডেকে চলে।

এই হাপিত্যেশ দিনেও আশরাফ আলী ভাবে, কদিন বাদেই কবেকার পুরনো সেই মসজিদটির মাথায় ঈদের বাঁকা চাঁদ উঠবে। আর মনে মনে বলে, রমজান মাসে আমাদের নিয়ম করে রোজা করার কি দরকার? এমনিতেই তো আমাদের পেট রোজ রোজা নিয়ে বসে আছে। এখন রোজ শব্দটি আমাদের কাছে রোজা হয়ে গেছে!

আমি বাড়ি ফিরি। চোখ মুখ ধুয়ে ক্লান্ত পদক্ষেপে নিজের শোবার ঘরে ঢুকে পড়ি। ক্লান্তিতে ঘুম নেমে আসে। চোখের আয়নায় আমি একের পর এক দেখতে পাই বোমা হাতে ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী মজফফরপুরের রাস্তায়, পিস্তল হাতে বিনয়-বাদল- দীনেশ রাইটার্সের বারান্দায়, মাস্টারদা-প্রীতিলতা-কল্পনা অস্ত্রাগারের ভেতরে, বাঘাযতীন বুড়িবালামের তীরে…

আমি জানি, এইসব মধ্যবিত্ত স্বপ্ন অলীক কল্পনা মাত্র। এ এক উত্তেজনা বাস্তবকে এড়ানোর সুচতুর কৌশল। এইসব বিগত ধূসর স্মৃতি আমার সুপ্ত ইচ্ছার কাছে সুখ হিসেবে চলমান পণ্য-চিত্র হয়ে দাঁড়ায়।