বাঙালি বিস্মৃত ও বিস্মিত জাতি। অকৃতজ্ঞ জাতি। বাংলা সংবাদপত্রের জনক অগ্রদূত, যাকে কেন্দ্র করে আজ ‘বিগ হাউস’ ও ‘মিডিয়া’ শিরোপা পেয়েছে সংবাদপত্রওয়ালারা আর কোটি কোটি টাকার কারবারি হয়ে যাচ্ছে,তারা কেউই স্মরণ
করে না সেই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জন্মদিন। এমনই অকৃতজ্ঞ এই বাংলা মিডিয়া। আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব তিনি কাঁচরাপাড়ায় জন্মেছিলেন।

অবতক, ৯ মার্চঃ চেতনাঋদ্ধ রৌদ্রময় এই ভূখণ্ডে একটির পর একটি ইতিহাস মিছিল করে হেঁটে যায়।
কাঞ্চনপল্লীর সেই গহন অরণ্যভেদী প্রত্নতাত্ত্বিক ভিত্তি স্পর্শ করে বাগ মৎস্যবাজার পাড়া মাতিয়ে কুমারহট্টে আলোড়ন তুলে বীজপুরের জনপদকে তোলপাড় করে এখানকার মানুষটিই সবচেয়ে আগে সুখসংবাদটি পাঠিয়ে দিয়েছিল সুতানুটি, গোবিন্দপুর গাঁয়ে।
সেই সংবাদ জীবনের সুস্থির বার্তা, প্রগতির সমাচার হয়ে বিস্তীর্ণ গাঙ্গেয় জলভূমিপূর্ণ এই বাঙলার উপত্যকায় তুলেছিল জিজ্ঞাসার ফেনিল উচ্ছ্বাস।
তাই সংবাদপত্রের জগতে এই বঙ্গভূমে বীজপুর একটি মাইলফলক।
আজ সেই যুগন্ধর কবি-সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জন্মদিন।
কোনদিন এই আনপড় গাঁ থেকেই রক্ষণশীল পরিবারের ধাঁচা থেকেই কাঞ্চনপল্লী পাঠিয়েছিল বাংলার দৈনিকের প্রধান সাংবাদিক-সম্পাদককে।
কবিরাজি স্বর্ণসিন্দুর আর মধুর সংযোগে ঔষধি নির্মাণের পরিবারে যে সাংবাদিকের জন্ম হয়েছিল কাঞ্চনপল্লীর ধূলিধূসরিত আাঙিনায় যে কালব্যাপী তুফান তুলেছিল সাংবাদিকতার জগতে, সেই Last of the Ancient and First of the Modern সাংবাদিকের কাছে আমরা নতজানু।
১৮১২ সালের ২৫ শে ফাল্গুনী বসন্তের ক্রান্তি লগ্নে কাঞ্চনপল্লীর বাগানে ফুটে উঠেছিল এক দায়বদ্ধ সম্পাদক-মালি যার হাতে ছিল সংবাদপত্রের বাগান তৈরীর খুরপি, নিড়েন ও জল দেবার ঝাঁঝরি। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, তিনি আমাদের ভূমিপুত্র।
১৮৩১, ২৮ জানুয়ারি শুক্রবার বেরিয়েছিল সংবাদ প্রভাকর সংবাদপত্র তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ বছর। সংবাদপত্রের সম্পাদনায় কাঁচরাপাড়ার এই বালক এই ভূমিপুত্র ঈশ্বরগুপ্ত।
১৮৩৬, ১০ আগস্ট। সেই সংবাদপত্র হয়ে গেল বারত্রয়িক। তারপর সৃষ্টি হলো ইতিহাস। ১৮৩৯, জুন। ঈশ্বরগুপ্ত নির্মাণ করলেন বাংলাভাষার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র, যুগ যুগ জিও কাঁচরাপাড়া।
তারপর সংবাদপত্র জগতে বীজপুর ক্রমান্বয়ে ইতিহাস হয়ে গিয়েছে।
তার সংবাদপত্রে তিনি কি তুলে ধরতেন? ঈশ্বরগুপ্ত সামাজিক ন্যায় অন্যায়, গার্হস্থ‍্য জীবন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক সমানভাবে তুলে ধরতেন। সিপাহীবিদ্রোহের কালে তাঁর সংবাদপত্র একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। অনেকে তাঁকে সিপাহি বিদ্রোহ বিরোধী বলে মনে করেছিলেন। তাঁর এই বিষয়টি এখনও সমালোচকদের দৃষ্টিতে বিতর্কিত।
তাছাড়া যেখানে যে কোনো অন্যায় অত্যাচার তিনি দেখেছেন, তিনি তা তুলে ধরেছেন। তার সংবাদপত্র ছিলো অনেক সাংবাদিকেরই আঁতুড়ঘর। তিনি হাতে শিখিয়ে তৈরী করেছেন অনেক সাংবাদিক। তাঁর পত্রিকায় লিখেছেন সেই বিস্ময়ী বালক! বঙ্কিচন্দ্রের স্কুলিং হয়েছিল তাঁর পাতায়। এই বঙ্কিমচন্দ্রই পরবর্তীতে তাঁর আনন্দমঠে বৈপ্লবিক বাণীর উজ্জীবনী শক্তির স্লোগান দিয়েছিলেন। তাঁর সংবাদপত্রে গদ্যে হাত পাকিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। দিনের দিন সবদিন ভারত হবে পরাধীন জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছেন, উত্তাল হয়েছিল বাতাস। সেই মনমোহন বসু কলম ধরেছিলেন তাঁর সংবাদপত্রে। দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণের নাট্যকার, তাঁর কলমে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এই দৈনিক সংবাদপত্র।
ইংরেজ উপনিবেশীয় দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে তুমি কলম ধরেছিলে।
সেসময়ের সংস্কৃতিবানদের গোঁড়ামি, ধর্মীয় জল্লাদদের হুঙ্কারের বিরুদ্ধে তুমি কোনো তোয়াক্কা করোনি। তুমি তাদের বলেছিলে নস্য লোসা দধি চোষার দল।
ইংরেজি অপসংস্কৃতি রুখতে তুমি লিখেছিলে, ” তুমি মা কল্পতরু, আমরা সব মোষ গরু, শিখিনি সিং বাঁকানো”। বাংলায় যখন নেমে আসছে উদ্ভ্রান্ত সংস্কৃতি, সাহিত্য জগতে, সংস্কৃতি জগতে এজটা মহব্বত খানার রস, তখন তুমি লিখলে– গুড়ু গুড়ু গুম গুম লাফে লাফে তাল/ তারা রা রা রারা রারা/ লালা লালা লালা লালা লাল। ১৮২৯ সালে সতীপ্রথা বিলুপ্ত হল। রামমোহন নিলেন অগ্রণী ভূমিকা সেইসময় তোমার সম্পাদনা হয়ে উঠেছিলো উল্লেখযোগ্য এবং ঐতিহাসিক।
১৮৩০ সালে নীলকর আন্দোলনের পক্ষে তুমি কলম ধরলে। তুমি লিখলে– নীলের কুঠি হতেছে কুটি কুটি/ দুখি লোকের প্রাণ মারা যায়/ পেটে খেতে নাহি পায়। ১৮৪৫ সালে মিশনারী ডাভ সাহেবের গা জোয়ারিতে ধর্মান্ত করালেন নাবালক উমেশ সরকার ও তার নাবালিকা স্ত্রীকে। এটা ছিলো একটা সাম্প্রদায়িক অসভ্যতা। এর বিরুদ্ধে তুমি প্রভাকরের পাতায় মূর্ত হয়ে উঠেছিলে।
তুমি আমাদের সামনে উজ্জ্বল উদ্ধার রামপ্রসাদ সেনকে এনে দিয়েছো। যিনি লিখেছিলেন–এমন মানব জমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলতো সোনা। এমন বহু প্রত্নতাত্ত্বিক মানুষকে তুমি আবিষ্কার করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলে।