অন্য বসন্ত
তমাল সাহা

গোরস্থান। আদ্যিকালের বুড়ো বটগাছটার নীচে চিরাগ জ্বলছে। ওখানে পীর বাবার মাজার আছে। এদিকে একটি কদম গাছ। বর্ষাকালে কদম ফুল ফোটে। ভারি মৃদু সুবাস তার। আর ওই কোণে একটা শিমুল গাছ। এখন লালে লাল হয়ে আছে।

তুমি-আমি তখন সবে পাশাপাশি হাঁটা শুরু করেছি। মনে পড়ে তোমার? এই মাঠেই মাদারি খেল হতো। হতো সার্কাস। ন্যাড়াপোড়া হতো। এইসব দেখার অজুহাত দেখিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তুম। যতক্ষণ কাছাকাছি থাকা যায় এই আর কি!

পড়শি মেয়েকে ভালোবাসলে সুবিধে অসুবিধে দুটোই আছে। ঘনঘন কাছাকাছি হবার সুযোগও থাকে, ভয়ও থাকে।

প্রাক পূর্ণিমার চাঁদ তখন ডাগর হতে চলেছে। তুমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে চাঁদের দিকে। আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতুম, তোমার মুখে চাঁদের আলো পড়েছে। ওই তো দূরে মাঠের মাঝে ন্যাড়াপোড়া হচ্ছে। কাল তো দোল পূর্ণিমা। এখন বলে বসন্তোৎসব।

তুমি জানতে চাইতে, ন্যাড়াপোড়া বলে কেন?

আমি বলতুম, বছরের প্রান্তিক বেলা এসে পড়েছে। সব মালিন্য, জীর্ণতা দূর করে দাও। নতুনকে স্বাগত জানাও। ন্যাড়াপোড়া একটা প্রতীকী।

তুমি বলতে, বুঝলুম, বাবা বুঝলুম। ও! তাই তো রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন,
আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো…
আর বলতে, জানো তো
দেব দেবীরাও রঙ খেলে।

আমি বলতুম, ওসব ছুতো নাতা। বুঝেছি! রঙ খেলার ইচ্ছে হয়েছে।
আজ রাধে! হোলি খেলবো তোমার সঙ্গে। বসন্ত এলে রঙ তো জাগবেই মননে।

তুমি বলতে, কেন?

আমি বলতুম, প্রকৃতির দিকে চেয়ে দেখো। তুমি কি দেখতে পাওনা প্রকৃতি কেমন সাজে লাল, হলুদ, বাসন্তী ফুলে! যত ফুল, যত ফুলের গান, সমারোহ এই বসন্তে।
হলুদ আর লাল। এ দুটো ফুল তুমি দেখবেই।
বসন্তকে লোকে ঋতুরাজ বলে। আমি বলি ঋতুরানি।

আর তারপরেই তুমি গেয়ে উঠতে সেই গান– “বনমালী! তুমি পর জনমে হইও রাধা…”
আর তার পরেই তুমি আবার গেয়ে উঠতে সেই অনুভবের নিবেদন। কোন্ গান, বলো তো?
“প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।”

মনে পড়ে, তুমি সেই গান শুনে আমায় ডাকতে, বাসন্তিকা! আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনী দুটো দিয়ে আমার গাল আলতো টেনে বলতে– তুমি খুব ভালো গাও তো!

আমি তখন ধূসর স্মৃতিকে বর্ণময় করে তুলতুম। বলতুম– তোমার মনে পড়ে, তুমি গ্রীষ্মে আমাকে ডাকতে রৌদ্রালী বলে, বর্ষায় ডাকতে মেঘমালা, শরতে কমলিকা।হেমন্তে যেন কি ডাকতে? ও! মনে পড়েছে। ঝরাপাতা। আর শীতে? এই শীতু!

আমি বলতুম, এ কথাটা তুমি নিশ্চিত ভুলে গেছ! তুমি বলতে, শ্রীকৃষ্ণ পিচকিরি দিয়ে জলগোলা রঙে রাধাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে সেই ছবিটা তুমি দেখেছো?

আমি বলতুম, এতসব কথার তো দরকার নেই। চলো কাল বোলপুরে যাই। পুরবাসীকে তো রবীন্দ্রনাথ সেই কবেই রঙ খেলার আহ্বান জানিয়েছেন। খোয়াইয়ে সন্ধ্যের দিকে যাবো। পূর্ণিমার চাঁদ দেখবো–সোনাঝুরি গাছের মাথার উপরে। নীচে টিলা খন্দরে লাল মাটির উপরে বসে কথা হবে। খোয়াইয়ের জলধারা বয়ে যাবে।

কী কথা? কী কথা? কী কথা?
আসলে কোনো কথাই হয় না। নীরবতায় বাঙ্ময় কথা হয়। চোখ ভাষা পায়। ওষ্ঠ স্পর্শের কথা বলে। কর্ণকুহরে প্লুতস্বর প্রবেশ করে। বলে, কাছে এসো।আরও নিকটে এসো…ও..ও…
সমর্পণ করো, বসন্ত বলে যায়।