সিয়াচেন নামটার সাথে জড়িয়ে রয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক অজানা ইতিহাস। ‘সিয়াচেন ‘শব্দটা পরিচিত হলেও এর অর্থটা হয়তো অনেকেরই অজানা, এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো “গোলাপ ফুলের ক্ষেত্র “। কথায় বলে না,গোলাপের মনোহরনি সৌন্দর্য যেমন রয়েছে তেমনি তার ডালেও রয়েছে একরাশ তির্যক কাঁটা। বরফের মরুভুমি সিয়াচেনের ছবিটা অনেকটাই সেইরকম।

এখানকার সিন্গ্ধ পরিবেশে চব্বিশঘন্টাই যুদ্ধের বাতাবরন কাঁটার মতোই বিরাজমান। এমন এক জনমানবহীন ধু-ধু কার তুষারাবৃত্তে রাত দিন কেবল শব্দের প্রতিযোগিতা চলে, তুষার আর গুলির সেই গর্জনের দর্শক কেবলমাত্র পর্বতের শৈলরাশি হিমবাহ আর আমাদের ভারতীয় জওয়ানরা। দুনিয়ার সবথেকে উঁচু যুদ্ধক্ষেত্র বলা হয় সিয়াচেনকে,সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা প্রায় 22,000 ফুট এটা হিমালয়ের কারাকোরাম রেঞ্জ এ অবস্থিত। সেই 1984 সালের পর থেকেই ভারতীয় সেনারা সেখানে একটানা ডিউটিতে কর্মরত। শুনলে অবাক হবেন এখানকার সারাবছরই উষ্ণতা থাকে হিমাংকের নিচে দিনেরবেলা কখনো -53°c কিংবা তারও কম আর রাতের তাপমাত্রা থাকে -70°c কাছাকাছি, সত্যিই জীবনের বাঁচার অনুপযোগী এককথায় প্রাণঘাতিক এক পরিবেশ, তারই মধ্যে কখনো রয়েছে শত্রুর অতর্কিত আক্রমন কাজেই সিয়াচেনের অন্দরমহলের ইতিহাসটা বরাবরই অন্যরকমের এখানে মৃত্যু সর্বদা ছায়ার মতোই ঘুরে বেড়ায়। আমাদের ভারতীয় জোওয়ানদের সিয়াচেনে মাত্র তিনমাসের পোস্টিং হবার আগের প্রস্তুতির পর্বগুলো দর্শক শ্রোতাদের রক্তকে হিম করে দেয়। কঠিন থেকে কঠিনতম প্রশিক্ষনের পর পরীক্ষায় উর্তীন্ন হলে তবেই কোনো জোওয়ানকে পোস্টিং করা হয় সিয়াচেনে। আসলে আমাদের সেনাবাহিনীর যে ধরণের ক্ষমতা, সৈনিকদের যা সম্পদ রয়েছে তার কেবলমাত্র
0.0001% সাধারণ মানুষ দেখতে বা জানতে পারে।

গুলমার্গের হাই অলটিটুউড ওয়ারফায়ার ট্রেনিং সেন্টার থেকে স্পেশাল কমান্ডো ফোর্সের ট্রেনিং সমাপ্ত হবার পর শুরু হয় পোস্টে যাবার। বর্তমানে সেখানে দেড়শোটি সেনা ক্যাম্পে প্রায় দশ হাজার জোওয়ান ভারতমাতা তথা দেশবাসীর রক্ষার্থে সদা প্রস্তুত। ব্রেসক্যাম্প থেকে দেড়শো কিলোমিটার দুরে অবস্থিত এক একটা পোস্ট এ জোওয়ানদের পৌঁছাতে সময় লাগে অন্তত কুড়ি দিন, সুতরাং বুঝতেই পারছেন বাকি পদক্ষেপগুলো আরো কতটা ভয়াবহ। বরফের পাহারীরাস্তায় হাঁটাপথ বেয়ে কখনোবা বরফ কেটে রাস্তা তৈরী করে এমনকি ট্রেকিং করেও গন্তব্যে পৌঁছাতে হয় আমাদের জোওয়ানদের। এহেন হিমশীতল দেশের প্রতিপক্ষ শুধুই চিন কিংবা পাকিস্তানই নয় এ অঞ্চলে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করাটাও একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এখানের বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমান এতই কম যে জোওয়ানদের শ্বাসনিতেও যেমন কষ্ট হয় আবার তিনমাসের জন্য ডিউটিতে গিয়ে অনেকের শরীরে বাসা বাঁধে “বনম্যারো ক্যান্সার” কখনোবা “মেমোরি লসের” মতোও নানান ভয়ঙ্কর ব্যাধি, চারপাশে তুষারের ঝোড়ো হাওয়ায় কারোর সাথে কথা বলা কিংবা শোনা এখানে শত দুরস্তব্যাপার। বরফের রাস্তার প্রতি পদক্ষেপেই রয়েছে একাধিক গুহা আর ফাটলের সারি, এমনকি মুহূর্তের অসাবধানতায় পিছলে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর সম্ভবনা থাকে অনেক বেশি, তাই নিজেদের মধ্যে দড়ি বেঁধে একে ওপরকে রক্ষা করেন এখানকার সেনা জোওয়ানরা। সেনাদের পরনের এক একটা স্নোকোর্টের ওজন তিন কেজির কাছাকাছি। এছাড়া ক্লাইনবিং এর সময় প্রত্যেকের পিঠেই থাকে অক্সিজেন সিলিন্ডার ভর্তি তিরিশ কেজির বেশি ওজনের একটা ব্যাগ। সিয়াচেনে জোওয়ানদের খাবারের ব্যবস্থা করাহয় কপ্টারের সাহায্যে এতটাই দুর্গম পরিবেশ যে মাত্র তিরিশ সেকেন্ডের বেশি ল্যান্ড করতে পারে না কোনো কপ্টার এমনকি মাঝে মধ্যেই প্রবল তুষার ঝড়ের কবলে হেলিকপ্টারও বরফের নিচে চাপা পড়ে যায়। জওয়ানরা তাঁদের ঘুমোনোর সময় স্লিপিং ব্যাগ ব্যবহার করেন। স্লিপিং ব্যাগ ছাড়া ক্যাম্পে ঘুমানো মানে মৃত্যুকে যেন নিজের কাছে ডাকা।

জিন্দেগী ইয়া মত সিয়াচেন যুদ্ধক্ষেত্রের পরস্পরের সাথি। আমাদের দেশের প্রতিবছর প্রতিরক্ষাখাতের হাজার কোটি খরচ করা হয় সিয়াচেন রক্ষার্থে। সংবাদ মাধ্যমে এতোটুকু খবর দেখে আমি আপনি সবাই বেশ নিশ্চিত হই, আমরা সত্যিই নিরাপদ কিন্তু কেন্দ্রস্থলের প্রতিটা দিন প্রতিটা ঘন্টা প্রতিটাসেকেন্ড যারা একদিকে শত্রুকে রেখে অন্যদিকে পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করেচলেছে প্রতিনিয়ত, যাঁরা দেশকে বাঁচাতে গিয়ে জীবনের পুরোটাই ঢেলে দিয়েছেন এতোটাকাল, তাদের সেই উপলব্ধি ঘরে বসে টিভি দেখে কি সম্ভবপর? অপদকালীন পরিস্থিতিতে যাঁরা চিরকালই সদা সতর্ক, তাদের নিয়ে যখন শাসক বিরোধীর রাজনৈতিক ভোট যুদ্ধের তরজা চরমে ওঠে তখনো এটুকুবা প্রভাব পড়ে না কোনো জোওয়ানের কর্তব্যে, একান্ত চিত্তে নির্বাক মনে নিঃশব্দে নিজেদের দায়িত্বে তাঁরা সদা প্রস্তুত, পরোক্ষে কারোর কিছু বলা কিংবা না বলা শব্দগুলোকে পাশ কাটিয়ে একনিষ্ট ভাবে নিজের কাজটা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছেন আমাদের যোদ্ধারা। আপনার আমার থেকেও দেশসেবার কর্তব্যে যাদের আবেগ রয়েছে অনেক বেশি, যাদের চেতন জুড়ে আছে শুধুই জয়েরবার্তা,তাই বাকি সাচ্ছন্দ গুলোকে দূরে রেখে কথায় কথায় নিজের জীবনকে বাজি রাখতে পারেন ওঁরা। কোনো শত্রুপক্ষ যদি বন্দেমাতরমের বিন্দুমাত্র অবমাননা করে তখন নিমেষেই চারিদিক থেকে জ্বলে ওঠে আগুন— ‘শালে কো ঠোক দো ‘
তাই স্বাধীনতার পর এতো গুলো বছর ধরে আমরা সুরক্ষিত, নিরাপদ আমাদের সেইসমস্ত যোদ্ধাদের হাত ধরে।
সুমনা আদক —-