বিনয় ভরদ্বাজ, অবতক খবর,২৫ জুন: লোকসভা নির্বাচনের পর হাত ছাড়া নৈহাটি পৌরসভা দখল করতে সক্ষম হয়েছে তৃণমূল। এক এক করে বিজেপিতে যোগদানকারী কাউন্সিলররা দলে ফিরে এসেছেন। ফের চেয়ারম্যান হন অশোক চ্যাটার্জী। এখন বর্তমানে তিনি নৈহাটী তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি ও পৌর প্রশাসক পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

নৈহাটিতে ভেঙে পড়া দলকে ফের সংগঠিত করে ধীরে ধীরে আরও শক্ত ঘাঁটি তৈরি করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে লেগেছেন বিধায়ক পার্থ ভৌমিক। তাই তাঁর নেতৃত্বে প্রতিদিনই চলছে নৈহাটির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিজেপি কর্মী সমর্থকদের ভাঙিয়ে এনে পুনরায় তাদের দলে যোগদান করানোর পালা।

সামনে বিধানসভা নির্বাচন। তাই দলে ঐক্যের বার্তা দিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। নিজেও ঐক্যের বার্তা দিয়ে সকলকে সংগঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন বিধায়ক পার্থ ভৌমিক।  এতসবের পরেও দলের ভেতরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কম হচ্ছে না। বাইরে বাইরে ঐক্য দেখানোর চেষ্টা হলেও ভেতর ভেতর দলের প্রতি পদে রয়েছে অনৈক্য গোষ্ঠী কলহ । তা রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরা ভালোই বুঝতে পারছেন,এছাড়াও বাইরে থেকে নবাগত দলে যোগ দেওয়া যুবকরাও ।

বর্তমানে নৈহাটি বিধানসভাতে কয়েকটি তৃণমূলের গোষ্ঠী সোচ্চার আছে। যদিও প্রত্যেক গোষ্ঠী পার্থ ভৌমিককে তার নেতা বলে মনে করে। তবে তাদের নিজেদের মধ্যে কলহ চোখে পড়ছে আনাচে-কানাচে । কোন এলাকা কার দখলে থাকবে, এ নিয়ে মাঝে মাঝেই তাদের সংঘর্ষ মানুষের সামনে চলে আসছে।

প্রথমেই কথা বলা যাক অশোক চ্যাটার্জী অর্থাৎ নৈহাটি তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি এবং নৈহাটি পৌরসভার চেয়ারম্যান বর্তমানে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর-এর গোষ্ঠীর। অশোক বাবু ভীষণ খাটাখাটি করার মানুষ। তাঁকে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষের জন্য খাটাখাটনি করতে দেখা যায় বিশেষ বিশেষ সময়ে। দীর্ঘদিন ধরে নৈহাটির তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি এবং এর পাশাপাশি নৈহাটি পৌরসভার তিনি চেয়ারম্যান পদ সামলে আসছেন। নৈহাটিতে প্রত্যেক ওয়ার্ডে তাঁর অনুগামীরা রয়েছেন।

এছাড়াও তাঁর ছেলে অভিজিৎ চাটার্জীর যুবকদের নিয়ে বেশ ভালো একটি বাহিনী রয়েছে। যদিও এই বাহিনীর লোহা ঘাটে মদ পান করার জন্য বেশ  বদনাম রয়েছে।তবে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের পালা এলে তাদের বাইক বাহিনীর ক্ষমতা চোখে পড়ার মতন।

দ্বিতীয় বড় গোষ্ঠী রয়েছে নৈহাটি পূর্ব পারের যুবনেতা ও যুব সভাপতি সনৎ দে-র। সনৎ বাবু দীর্ঘ ২০১১ থেকে যুব সভাপতি রয়েছেন। তাঁর নিজস্ব টিম তিনি তৈরি করে ফেলেছেন। এলাকার মানুষ বলেন, একসময় তার দুধের ব্যবসা ছিল, ঘরবাড়ি বন্ধক ছিল ব্যাংকে। কিন্তু এখন তার রমরমা বাজার।সফল ব্যবসায়ী ও কোটি টাকার মালিক। নৈহাটি পূর্বপারে তৃণমূলের শেষ কথা সনৎ দে-ই বলেন, কিন্তু ইদানিং ক্ষমতায় ভাগ বসিয়েছেন আলাদা গোষ্ঠী করে হকার নেতা বিষ্ণু অধিকারী।

বিষ্ণু নৈহাটির দুই পার্থর প্রিয়। বিষ্ণু অধিকারীকে পার্থ ভৌমিকের ভক্ত ও পার্থ দাশগুপ্তর প্রিয় বলে মনে করা হয়। বিষ্ণু এখন যুবকদের নেতা, নৈহাটি হকারদের নেতা। তবে দিন দিন বিষ্ণুর দাপট যেভাবে বাড়ছে এতে সনৎ দে-র মাথা মাঝেমাঝেই বিগড়ে যাচ্ছে। বিষ্ণুর ছেলেছোকরাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই সনৎ বাবুর গোষ্ঠীর গন্ডগোল বাঁধছে। এখন সনৎ বাবুর যুবকরা ভেঙে ভেঙে  বিষ্ণুর দিকে যোগ দিচ্ছেন। তাতে যুব সভাপতির ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।

নৈহাটি রাজনৈতিক মহলের ধারণা,সনৎ বাবুর উপর নির্ভরশীল না থেকে বিধায়ক পার্থ ভৌমিক এখন বিষ্ণুকে দিয়ে আলাদা শক্তি তৈরি করতে চান। তাই, বিষ্ণুর এই উত্থান। এছাড়াও বিষ্ণুকে শক্তিশালী করে তোলার পেছনে অন্য কারণও আছে। কারণ নির্বাচনের পর যখন দল সংগঠিত হয় আর পুনরায় তৃণমূল পৌরসভার ক্ষমতা দখল করে তখন সনৎ বাবু পার্টির সভাপতি বা চেয়ারম্যান দুটির মধ্যে একটি পদ চেয়ে বসেন।

তার দাবি ছিল, চেয়ারম্যান অশোক চ্যাটার্জী তাঁর ছেলে ও বাড়ির সকলকে নিয়ে বিপদের সময় এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তখন তিনিই এলাকায় দাঁড়িয়ে লড়াই দিয়েছেন। তাই দুটি পদে একসঙ্গে অশোক বাবুকে বসিয়ে না রেখে তাকে একটি পদ দেওয়া হোক। এছাড়াও লোকসভা নির্বাচনের গন্ডগোলের পর চেয়ারম্যান অশোক চ্যাটার্জী নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দল ক্ষমতায় ফিরলে তিনি দুটি পদের মধ্যে একটি পদ ছেড়ে দেবেন। দলকে আরো সংগঠিত শক্তিশালী করে তোলার স্বার্থে।

কিন্তু অশোক বাবু কোন পদ ছাড়েন নি। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে সনৎ দে এবং দলকে বিপাকে ফেলার হুমকি দেন। ৯ জন কাউন্সিলরও তাঁর হয়ে পদত্যাগ করতে রাজি হয়ে গেছিলেন। সিআইসি হেল্থ- এর পদ তিনি প্রত্যাখ্যান করে ফোন বন্ধ করে ঘরে বসে থাকেন। অবশেষে অনেক বুঝিয়ে তাকে খুশি করতে দুটি সিআইসি পদ দিয়ে শান্ত করা হয়।

এছাড়াও তখন তাকে বলা হয় যে, এই সময় গন্ডগোল নাপাকিয়ে তিনি 6 মাসের জন্য শান্ত হন। কারণ আবার সামনে নির্বাচন। নির্বাচনের পর  তার ইচ্ছা মতন ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। তাই নৈহাটিতে সনৎ বাবুর এই গাজোয়ারি ভাঙতেই বিষ্ণুর উত্থান বলে মনে করছেন অনেকে।

সনৎ দে-র ছেলেছোকরাদের সঙ্গে অশোক চ্যাটার্জীর ছেলে অভিজিৎ চ্যাটার্জীর গোষ্ঠীর ছেলেদের গন্ডগোল মাঝেসাজে লেগে থাকে। তবে বিষ্ণু চলে আসাতে এখন বিষ্ণুর উত্থান আটকাতে সনৎ বিশেষ নজর দিচ্ছেন তাই মাঝে মাঝেই বিষ্ণু ও সনৎ এক অপরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বিষ্ণু অধিকারী নৈহাটি বিজয়নগর পূর্বপাড়ে দ্রুত বিস্তার করছে । এছাড়াও তাঁর নেতৃত্বে গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও যুবকরা উৎসাহিত হয়ে তৃণমূলে যোগদান করছে । এর পাশাপাশি সনৎ কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অশোক চ্যাটার্জী ও অভিজিৎ এর সব রকম মদত থাকছে। তাছাড়া পার্থ ভৌমিক ও পার্থ দাশগুপ্তে  বিষ্ণুকে শক্তিশালী করে তুলতে শক্তি যোগাচ্ছেন।

নৈহাটীতে এদের পাশাপাশি সম্রাট রায়চৌধুরীর একটি দল রয়েছে। সম্রাট বিজেপি তৃণমূলে যোগদান করার সময় যুব সভাপতি পদ দাবি করেছিল। কিন্তু বিধায়ক পার্থ ভৌমিক তাকে ও তার দলকে পৌরসভার বিভিন্ন কন্টাকটারি ব্যবসা ও চাকরী দিয়ে রাজি করান ও তাকে যুব সাধারণ সম্পাদক পদে বসান। সম্রাট ও তার দলবলও সনৎ দের থেকে এখন ভাগ বসিয়েছে।

নৈহাটির গৌরীপুর অঞ্চলে হিন্দিভাষীদের নতুন নতুন ছেলে ছোকরাদের নিয়ে মিঠুন পাশওয়ান একটি দল গড়ে তুলেছে। আর এই দলকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগদান করানো হয়। যোগদান করান সুবোধ অধিকারী নিজেই। কিন্তু যেসব প্রতিশ্রুতি মিঠুনকে পার্থ ভৌমিক ও সুবোধ বাবুরা দিয়েছিলেন সে সব প্রতিশ্রুতি তারা রাখতে পারেননি । মিঠুনের দাবি, অশোক চ্যাটার্জীও পার্টিকে টাকা যোগান দেয় কাউ। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বিখ্যাত মদ সাট্টা ও চোলাই ব্যবসায়ী কাউ।

মিঠুন পাসওয়ানের দাবি এই এলাকা থেকে ভাগ দেওয়ার কথা হয়েছিল তাকে। তার ছেলে ছোকরাদের কনট্রাক্টরী ব্যবসা দেওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু দলে যোগদানের পর তাকে কোন কিছুই দেওয়া হয়নি। বরং পার্টি অফিসে ডেকে কাউ এর সামনে এনে তাকে ছেড়ে দেয়া হলো। ব্যাপকভাবে মারধর করা হল তাকে। পুলিশকে লেলিয়ে নাজেহাল করতে শুরু করে দিলো তারা। তার অনুগামীদেরও ভুয়ো মামলা দিয়ে জেলে পাঠাতে শুরু করল। আর শেষে তাদের জোর করে তৃণমূলে যোগদান করিয়ে দেওয়া হল। তাই দল বদল করে মিঠুন ফের বিজেপিতে ভিড়েছে।

এছাড়াও নৈহাটি গৌরীপুর এলাকা দেখাশোনা করতেন মনোজ জয়সাওয়াল, রামনাথ সাউ ও রাজেন্দ্র গুপ্তা। এই অঞ্চলে এদের একটি ভালো গোষ্ঠী রয়েছে। এই হিন্দিভাষী অঞ্চল দেখা শোনা করতেন এরাই। কিন্তু এখন তাদেরকে ক্ষমতা কেড়ে এলাকা থেকে আলাদা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে নিজের নিজের ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিয়েছেন বিধায়ক। তাদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাই ক্ষিপ্ত তাদের  অনুগামীরা।

এছাড়াও নৈহাটিতে বিশেষভাবে সক্রিয় নৈহাটির প্রাক্তন টাউন তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি পার্থ দাশগুপ্তর অনুগামীরা। নৈহাটিতে দুই পার্থর জুটি বহু পুরনো জুটি। তাদের একটি আলাদা আন্ডারকভার সক্রিয় গোষ্ঠী রয়েছে, যারা বিশেষ বিশেষ সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

এছাড়াও পার্থ দাসগুপ্ত ওরফে টুটুলকে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের দক্ষ খেলোয়াড় বলেও মনে করা হয়। টুটুল বাবুর প্রবীণ তৃণমূল কর্মীদের ওপর বেশ ভালই প্রভাব রয়েছে। এছাড়াও তিনি নবাগত ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে বেশ ভালই সম্পর্ক ধরে রেখেছেন। তাই দুটো মিলিয়ে তিনি এখনও নৈহাটি রাজনীতিতে বেশ প্রাসঙ্গিক।

তবে টুটুল বাবুর এই প্রাসঙ্গিকতা ও তাঁর প্রভাব কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না এলাকার সভাপতি ও বর্তমান পৌর প্রশাসক অশোক চ্যাটার্জী বলে দাবি টুটুল পন্থীদের। অশোক চ্যাটার্জী ও টুটুল বাবুর লড়াই ভেতর ভেতর প্রবল আকার নিয়েছে। তবে লড়াই যাই থাকুক না কেন পার্থবাবু অর্থাৎ টুটুল বাবুকে প্রত্যেক লড়াই শেষে মাত খেতে হয় অশোক চ্যাটার্জীর কাছে। নৈহাটির বুকে এই দুই দাপুটে নেতারা লড়াইতে দিশেহারা ছাত্র যুব সমাজ। অশোক চ্যাটার্জীর ব্যবহারে অপমানিত বোধ করে এখন বিস্ফোটক  হয়ে উঠেছেন পার্থ দাসগুপ্ত। বিভিন্ন মহলে তিনি অশোকবাবুর পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। তবে প্রশ্ন,কেন এই বিস্ফোরণ , কেন এই দাবি ? এসব সবই আমরা জানাবো তবে আজ নয় , অপেক্ষা করতে হবে আগামীকাল পর্যন্ত । দেখুন :-  নৈহাটির তৃণমূলের গোষ্ঠী কলহ ও রাজনৈতিক সংগ্রাম “পর্ব- ২”