চন্দ্রালোকে ভারতবর্ষের লাশ
তমাল সাহা

এবার চলো ঘুরে আসি। ভারত মরণতীর্থে যাই। শোনো তথাগত! এখন মৃত্যুতে লাগেনা ফুল, তুলসী কোরা-থান, ঘি, অগুরুর ঘ্রাণ, মন্ত্র এমনকি আগুনও কখনো। শুধু লাগে বালি আর মাটি। এই মর্ত্যলোকে দুচোখ ভরে কত কী দেখি! চারিদিক সুনসান নিস্তব্ধ নীরব। শুধু শব, আর শব, আরো শব।

গিয়ে বসি বেনারস ঘাটে। নদীপারে ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকে আছে দুটি শব।
আরো দুটি লাশ দেখি অন্য পারে। পুঁতে দেওয়া হয়েছে অগভীর জলে কাদার ভিতরে।

উন্নাওয়ের *র্ষণের কথা মনে আছে তোমার! উন্নাওয়ের গাঙ্গেয় পারে সারি সারি মৃতদেহ বালির আস্তরণে কোনমতে চাপা দেওয়া! মৃতদেহগুলি গেরুয়া কাপড়ে মোড়া। শবের উপরে শামিয়ানা এখন শুধু আকাশ। কুকুরের দল পায়ে বালু সরিয়ে গেরুয়া কাপড়কে তুচ্ছ করে মড়া খেয়ে যায়।
গাজিপুরে গঙ্গার পবিত্র জলে ভেসে যায় কত লখিন্দর, বেহুলার একশোটিরও বেশি দেহ। বালিয়ায় গাঙ্গেয় স্রোতে ভেসে যায় বাহান্নটি শব।
উত্তরপ্রদেশের চন্দ্রৌলী ঘাট থেকে উদ্ধার হয়েছে ছটি দেহ। ঐ দেখো কুকুর তো আছেই, শেয়ালও, দিনে বেরিয়ে পড়েছে মড়া খাবে বলে। সোনালি ডানার চিল, ধূসর ঈগলেরাও উড়ে আসে। শবের সঙ্গে চিনে নাও পশুপাখি সব। জীবনে এই অপূর্ব সুযোগ, অভিজ্ঞতার আশ্চর্য বৈভব।

কনৌজে মহাদেবী ঘাটে ৩৫০ টি দেহ দাহ হলেও অগণন দেহ গঙ্গার জলের তোড়ে ভেসে যায়। খবর রটে যাবে বলে প্রশাসন তুড়ন্ত মাটি চাপা দেয়।

কানপুরের শেরেশ্বর ঘাটে পড়ে আছে ৪০০ জনের বালি চাপা দেহ।
শোনো শাক্যমুনি, ধৈর্য রাখো। মৃতের গল্প শোনো। বালিয়ার গঙ্গায় ১৫, এলাহাবাদ,বেনারস, চান্দৌলি,ভাদোহি, মির্জাপূর মিলিয়ে ৫০টি, ফতেপুরে ২০ জন মানুষের নিষ্প্রাণ দেহ ভেসে যায়…..
মধ্যপ্রদেশের রুঞ্জ নদীতে ভেসে আসে নগ্ন-অর্ধনগ্ন মানুষের দেহ। পচা দেহ জলে ভিজে ঢোল। কত ঘাটের নাম লিখে ফেলি আমি!

এসো আরো মৃত্যু দেখি। আমি কাপালিক, তুমি কপালকুণ্ডলা আমার! এসো,কপালকুণ্ডলে বলে ডাকি। এখানে মনসৃজা কবিতা কোথায়? রূপবান মৃত্যু, শ্রীময়ী মৃত্যুকে শুধুমাত্র দেখি।

এসো প্রিয়দর্শী। তুমি কি পূর্ণিমা রাতে যশোধরাকে রেখে কোনো বুনো জ্যোৎস্নায় বাইরে বেরিয়েছিলে! হাথরস উন্নাও গাঁয়ে দলিত নারীর বিধ্বস্ত যোনিদেশ তুমি দেখেছো, দেখেছো নারী-দাহপর্ব? হাঁসখালি কালিয়াগঞ্জ কালিয়াচক বগটুই— দাহ্যদেহ ঝলসানো মাংসপিণ্ড! চ্যাংদোলা শব্দটি তুমি শোনোনি নিশ্চিত। ধর্ষিতা মৃতা নারীর দেহ মাটিতে ঘষটাতে ঘষটাতে নিয়ে যায় পেয়াদা পাইক।
এসব শুনে সুজাতার হাতের পরমান্নে তোমার মুখে রুচি আসে?

বাকসার শ্মশানে স্থান নেই। বিহারের সেতুতে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে পুণ্যতোয়া জলে।
মৃত্যুর হাহাকারে বাদ যাবে কোন নদী? হামিরপুরে যমুনা নদী,গাজিপুরে গঙ্গাঘাট, বকসারের ঘাট, বেনারস ঘাট– সব শব ছুঁয়ে যায়….
অনন্ত এই তমসায় নক্ষত্রগুলি নিভু নিভু জ্বলে লজ্জায়।
পৃর্ণিমার জোয়ার থাকলেও জ্যোৎস্নার আলো নেই চাঁদের গায়। চিত্রগুপ্ত মৃত্যুসংখ্যার হিসেবের জাবেদা খাতা নিয়ে বসে ক্রমাগত হিমশিম খায়….

শোনো বোধিসত্ত্ব, শোনো সিদ্ধার্থ!
আমি তর্পণ করিনি কোনোদিন।কোমর ডুবাইনি জলে। জন্মদাতা জন্মদাত্রীকে ভালোবাসি বলে
করিনি মুখাগ্নি পিণ্ডদান। এখন এতো মৃতমুখ দেখে ভয় পাই। নীরব বাঙ্ময় কোলাহলে ছায়া ছায়া অশরীরীরা যেন পা ফেলে!
পাশে দেখি জল আগুন শব।
গেয়ে উঠি, ভালো থেকো তোমরা।
হে গৌতম অমিতাভ অনিরুদ্ধ
শুনতে পাও কি আমার নিস্তব্ধ স্তব!