গতকাল ২০১৮ সালে প্রয়াত বীজপুরের সুপরিচিত নাট্যকর্মী, গল্পকার প্রভাস ঘোষের গল্প সংগ্রহ প্রকাশিত হলো হালিশহর সাংস্কৃতিক সংস্থার ঘরে ঘরোয়া অনুষ্ঠানে

জীবনে লোক অনেক দেখেছি,একটি মাত্র মানুষ খুঁজে পেয়েছিলাম। সেই ছাপোষা মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই লেখা

তাঁহার কথা
তমাল সাহা

ফার্নেসের সুতীব্র উত্তাপে দেহ ভস্মরাশি হয়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম চিমনির গা বেয়ে উর্ধ্বমুখী উঠে গেল।
শেষ পর্যন্ত সেই ভস্মরাশি কোথায় যায়…
আমি নতজানু হয়ে বসে পড়ি,
কাতরে প্রার্থনা করি–
হে ভস্মরাশি! মহাশূন্যে বিলীন হবার আগে গাঙ্গেয় পলল মৃত্তিকা সমৃদ্ধ এই ভূপৃষ্ঠে তুমি বিস্তীর্ণ হও।
তোমার দুটি পায়ে পড়ি ,তুমি বিছন হয়ে ছড়িয়ে পড়ো,
কারণ এই ভস্মরাশির প্রতিটি অণু পরমাণুর গর্ভে সঞ্চিত রয়েছে সহিষ্ণুতা, সান্নিধ্য,সাহচর্য ও সংস্পর্শের বীজগুলি।
কারণ দেহ নশ্বর হলেও এই বোধগুলি অবিনশ্বর করে সে রেখে গেছে,
যেন নতুন প্রজন্ম এইগুলি আঁকড়ে বেঁচে থাকে।

সে তো আমায় অনেক কথাই বলেছিল,
সব তো আমার আজ আর মনে পড়ে না। মুথাঘাস,গুলঞ্চলতা চেনাতে চেনাতে
সে বলেছিল রবি শস্য,খারিফ শস্যের কথা।
আর কি বলেছিল?
একবার গাছের কথা ভাবো,
বীজ– মাটি ভেদ করে উপরে ওঠার তার কি প্রবল প্রচেষ্টা,
তারপর সে হল উদ্ভিদ।তারপর জল বাতাসে গাছ,গাছ থেকে বৃক্ষ,
বৃক্ষ থেকে বনস্পতি, মহীরুহ। দেখো, বনস্পতি আর মহীরুহ শব্দ দুটির মধ্যে একটু ক্ষমতায়নের স্পর্ধা আছে,
বৃক্ষের মধ্যে তা নেই,তাই বলে বোধিবৃক্ষ।
বোধি বনস্পতি,বোধি মহীরুহ বললে সেই বোধ,সেই ব্যঞ্জনাটা আসে না।
বোধিবৃক্ষ বললে একটা আশ্রয়,
খুব মাথাউঁচু নয় কিন্তু ডালপালা ছড়ানো একটা শান্ত সমাহিত ঠাঁই বলে মনে হয়।

নাভিকুণ্ড শব্দটি তার খুব পছন্দের ছিল।নাভিকুণ্ড নিয়ে
সে একটা গল্প লিখতে চেয়েছিল।
সে আমাকে বারবার নাভিকুণ্ডের কথা বলতো।জানো,
নাভিমূলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মাতৃত্বের বন্ধন।
জল-আগুনে এর ক্ষয় নেই।
মায়ের সঙ্গে নাভিমূলে জড়িয়েই তোমার জন্ম।মৃত্যুর পর অগ্নিশুদ্ধ হয়েই
নাভিকুণ্ড তোমার অস্তিত্ব নিয়ে জলযাত্রা করে।জন্মমৃত‍্যু জল ও আগুনের এক আশ্চর্যতম খেলা।
আমি নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো
তার কথা শুনে যেতুম।

এরিনা থেকে বেরিয়ে ফেরবার পথে
সে আমায় বলতো,নাও বিড়িটা ধরো।
আচ্ছা বলো তো চরিত্রটা কেমন হয়েছে!
সে বলতো, ওরা নাটক বলে,অভিনয় বলে,আমি কিন্তু তা মনে করি না।
আমার না শব্দ দুটো নকল নকল মনে হয়!
আসলে আমি চরিত্রটা করতে চাই,
অভিনয় বলব কেন,
যতক্ষণ অভিনয় বলবো ততক্ষণ সেটা লোকদেখানো নকলিপনাই থাকবে।
তখন একটা অজানা বিস্ময়ে আমি তার ফোলা ফোলা গালের উপর চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতুম।

সে শ্রম ও লড়াই মেশানো একটা গল্প শোনাতে শোনাতে বলেছিল,
রুটির গায়ে ঝোলা গুড় মাখিয়ে খাবার স্বাদটাই আলাদা— ঘামেভেজা
রুটি আর গুড়ের মধ্যে রসায়ন
তৈরি করল তোমার ওই স্বাদ।
আসলে জানোতো, এটা একটা সম্পর্ক তৈরি করল। রুটি গুড় আর তুমি উপরন্তু পেয়ে গেলে স্বাদ।

সে একটা গল্পে লিখেছিল, মার খেয়েও অন্ধকারের মধ্য দিয়ে গোপু পতাকাটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সে সেটাকে উঁচুতে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

আমি ভাবছি এখন নতুনভাবে—
অন্ধকার গোপু ও পতাকা বয়ে নিয়ে যাবার কথা।

কে গোপু?গোপু কে?প্রভাস!

প্রভাস শব্দটির মধ্যে কিসের
আভাস ছিল এতোদিন তার তল খুঁজিনি,
আজ যখন বুঝতে পেরেছি প্রভাস অর্থ উজ্জ্বল উদ্ধার তখন সে ধরাছোঁয়ার অনেক বাইরে চলে গিয়েছে…