এখন রাত ৮ টা ২০। শেষ রাতলেখা।

রামকুমার চট্টোপাধ্যায় টপ্পা ও পুরাতনী গানের এক কিংবদন্তি শিল্পী। ১৮ মার্চ তাঁর মৃত্যুদিবস।
বৈঠকী মেজাজে অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি করে গাইতেন তিনি। ‘কাদের কুলের বউ গো তুমি…’ বললেই কার না মনে পড়বে রামকুমারের কথা!

তমুর গল্পঃ
কাঁচরাপাড়ায় রামকুমারের জামাই ষষ্ঠী
তমাল সাহা

রামকুমার ছিলেন সাবেকি উত্তর কলকাতারমানুষ। সুতানুটি গাঁয়ের দর্জিপাড়ায় ছিল তাঁদের বাস। তখন পালকি-বেহারা ও ফিটন গাড়ির যুগ। রামকুমারের জীবন ঘটনাবহুল। তিনি যেমন অনেক কিছু দেখেছিলেন, তেমন মনে রাখতে পারতেনও প্রচুর।

সাবেকি সনাতন তাঁর জীবন যাপন। তখনতো সাহেবি-কেতাবি কলকাতা। দাদাঠাকুর-শরৎচন্দ্র সেসব তোয়াক্কা করতেন না। তিনি উদোম গায়ে, খালি পায়ে রেডিও স্টেশনে আসতেন মানে আকাশবাণীতে। সেখানেই দাদাঠাকুরের সঙ্গে রামকুমারের দেখা। প্রথম মোলাকাতেই দাদাঠাকুর তাকে শুধোন, এই খোকা! এখানে কেন? কেতাদুরস্ত কলকাতায় দাদাঠাকুরের অমন অভব্য পোশাক দেখেই তো রামকুমার ঘাবড়ে যান। তার উপর এমন দরাজ গলায় প্রশ্ন! উত্তরে রামকুমার বলেছিলেন, ‘আমি গাই’। ব্যাস, আর যায় কোথায়? দাদাঠাকুর পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে দুবেলা ক’সের করে দুধ দাও’? পরে দাদাঠাকুরের কাছেই ‘দাদাঠাকুরের গান’ শিখেছেন তিনি।
কাজী নজরুলের প্রাণখোলা হাসির দমকের মাধ্যমেই রামকুমারের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটেছিল আকাশবাণীতে। হেদুয়ায় সুভাষ বোসের মিটিংয়ে কাজী নজরুলের সঙ্গে কোরাসে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গান গেয়েছিলেন রামকুমার। অবশ্য এরপরে আরো অনেক গান-ই রামকুমারেরা নজরুলের সঙ্গে ধুয়ো ধরতেন।
দুই বিখ্যাত শিল্পী আঙ্গুরবালা ও কমলা ঝরিয়ার ঝগড়ার সাক্ষাৎদ্রষ্টাও ছিলেন রামকুমার।
মল্লিকবাবুদের পেনেটির বাগানবাড়িতে গানের আসর শেষে মদ ও মাংসের আহার পর্বে মাংস কমতি পড়ে গেলে কিভাবে বাগানের বাঁদর ধরে তার ছাল ছাড়িয়ে রাতারাতি কষা মাংস তৈরি করে অতিথিবর্গকে আপ্যায়ন করা হয়েছিল তাও জানিয়েছিলেন রামকুমার।

এবার বলা যাক কাঁচরাপাড়ার কথা। রামকুমার প্রেম করেন নি তবে কাঁচরাপাড়ার হাসিকে দেখে প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। হাসির দাদা মুরারি মোহন ব্যানার্জি কাজ করতেন এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্ট ইস্কুলে গান শেখানোর ক্লাস করাতেন রামকুমার। মুরারিবাবুর খুব পছন্দ ছিল রামকুমারকে। একদিন ছোট বোন হাসিকে এয়ারপোর্ট স্কুলে নিয়ে গেলেন মুরারিবাবু। ক্লাস শেষ। মুরারিবাবু রামকুমারকে অনুরোধ করলেন একবারটির জন্য তার বোনকে দেখতে। দেখা তো হলো। রামকুমার ফেঁসে গেলেন।

রামকুমার নিজেই বলেছেন, হাসির সৌন্দর্যই ছিল আলাদা। মানুষের গায়ের রং যে এতো ফর্সা হতে পারে, হাসিকে না দেখলে তিনি নাকি তা বিশ্বাসই করতে পারতেন না।
শেষপর্যন্ত রামকুমার বিয়ে করলেন কাঁচরাপাড়ার এই মেয়েকে–জীবনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট মেয়েকে। জীবনবাবু তখন থাকতেন ব্রাডলে রোড (বর্তমান নেতাজী সুভাষ পথ)থেকে বেরোনো পশুপতি লেনে।

রামকুমারের প্রথম জামাই ষষ্ঠী খুব ঘটা করে হবে। বিশাল আয়োজন করলেন হাসিদেবীর বড়দা মুরারি ব্যানার্জি। জামাইষষ্ঠীর ক’দিন আগেই হাসিদেবীকে বড়দা নিয়ে এলেন কাঁচরাপাড়া। এদিকে জামাই ষষ্ঠীর দিনই বিশাল গানের আসর বসালেন ঋষি চৌধুরী জোড়াবাগানে। চৌধুরিরা বনেদি মানুষ, জমিদারি আভিজাত্য তাদের। রামকুমার ঋষি চৌধুরীকে বড়দা বলে ডাকতেন, ফেলতে পারলেন না তাঁর অনুরোধ। রাজি হয়ে গেলেন গান গাইতে। সমঝদার সব শ্রোতা পেয়ে রামকুমার গাইতে লাগলেন বৈঠকি গান।
রাত ১১টা বেজে গেল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল রামকুমারের আজকের জামাইষষ্ঠীর কথা, কাঁচরাপাড়ায় যাবার কথা। ঋষিবাবু বললেন, ঘাবড়াও মৎ! আমি পৌছে দেব। তাঁর ছিল বিলিতি গাড়ি– রেসিং কার। নিজে হলেন ড্রাইভার। পৌঁছে দিলেন রামকুমারকে কাঁচরাপাড়ায়।
কিন্তু অত রাতে সব শুনশান। পনেরো মিনিট দরজা ধাক্কানোর পর দরজা খুলে দিলেন হাসিদেবী। বৈঠকখানার ঘরে রামকুমারকে বসিয়ে রেখে ভিতরে চলে গেলেন। রামকুমার তো হতাশ! মিনিট দশেক পর হাসিদেবী ফিরে এলেন। বললেন, কাঁচরাপাড়ায় আসবার লাস্ট ট্রেন চলে গেছে। ওরা বুঝে গেছে, তুমি আর আসবে না। তা দেখবার পর সব খাবার দাবার বাইরের লোককে বিলিয়ে দিয়েছে।

এখন হয়েছে নতুন ঝামেলা। নতুন জামাই বলে কথা, তাও আবার প্রথম জামাই ষষ্ঠী! অত রাতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নতুন করে খাবার বানাতে হবে। শালারা বেরিয়ে পড়েছে ডিম জোগাড় করতে। মেয়েরা ময়দা মাখতে বসে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত রাত দুটো বেজে গেল। ডিম দিয়ে তিন রকম পদ তৈরি হলো। শালারা কোনোমতে কোনো মিষ্টির দোকান থেকে আনতে পেরেছে মাত্র দুটো পান্তুয়া। এই হলো রামকুমারের প্রথম জামাইষষ্ঠীর খাবার।

রামকুমারের সেদিন বড় অভিমান হয়েছিল। তার মতো নামী গাইয়ে জামাইয়ের জন্য অপেক্ষা করা গেল না! বেশি রাত হয়েছে তো কি! তাই বলে খাবার-দাবার বিলিয়ে দিতে হবে?
সুন্দরী বউ হাসি আর শালা ও শালা বউয়ের অনুরোধ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভোর চারটে কুড়ির ফার্স্ট ট্রেনে কাঁচরাপাড়া ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন রামকুমার রাগে-ক্ষোভে।
লোকে বলে, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ! রামকুমার শ্বশুরবাড়ি মুর্দাবাদ! বলে ফিরে গিয়েছিলেন।
এরপর আর কোনোদিনই জামাই ষষ্ঠীতে আসেননি কাঁচরাপাড়ায়।

তবে গান গাইতে কাঁচরাপাড়া- হালিশহর অনেকবার এসেছিলেন রামকুমার। ১৭ সেপ্টেম্বর,১৯৯৫ পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সমিতি, উত্তর ২৪ পরগণা জেলার আয়োজনে ১৫ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলা সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল হালিশহর লোক সংস্কৃতি ভবন এবং ক্রেগ পার্কে। ১৭ সেপ্টেম্বর ক্রেগ পার্কে সলিল চৌধুরী নামাঙ্কিত মুক্তমঞ্চে সন্ধ্যায় বসেছিল বৈঠকী গানের আসর। রামকুমার মাতিয়ে দিয়েছিলেন সেই আসর।
রামকুমার ৩০ নভেম্বর,১৯৯৮ রামপ্রসাদের ভিটেতে শ্যামাসঙ্গীত বিষয়ক এক আলোচনা সভায় গান গেয়ে আসর প্রাণময় করে তুলেছিলেন।আয়োজক– গুড উইল ফ্রেটার্নিটি। এই আলোচনার স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন নজরুল বিশেষজ্ঞ বাঁধন সেনগুপ্ত। এই বিশেষ অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, সরোজ কুমার দত্ত এবং গ্রন্থনায় ছিলেন বাঁধন সেনগুপ্ত স্বয়ং। সে ছিল এক অনবদ্য অনুষ্ঠান।

১৯৭৮ সালের পয়লা বৈশাখ– কলকাতার রবীন্দ্র সদনে আয়োজিত হয়েছিল প্রভাতী বৈঠকী গানের আসর।সেই অনুষ্ঠানে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তমুর মুখোমুখি দেখা। সঙ্গে তমুর দুই বন্ধু প্রখ্যাত আবৃত্তিকার কাজল সুর ও শিবেন কুণ্ডু।
তমুদের নির্বাচিত কয়েকটি গান পরিবেশনের অনুরোধ রেখেছিলেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষে গ্রিনরুমে কথাও হয়েছিল। তমু পদধুলি নিয়েছিল তাঁর। এ এক স্মরণীয় ঘটনা তমুর জীবনে।

গুরু তারাক্ষ্যাপা দীক্ষা দেবার আগে রামকুমারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুই যে গান গাস তোর জিহ্বা শুদ্ধ হয়েছে? রামকুমার অকপটে জানিয়েছিলেন, না, গুরুদেব শুদ্ধ হয়নি।

সেই রামকুমার পরম শুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছেন ১৮ মার্চ ২০০৯। এসেছিলেন এই বসুমতীতে ২১ আগস্ট, ১৯২১।

এমন সব কত কথা,কত ঘটনা জমে আছে তমুর বুকের বারান্দায়….