অবতকের বিশেষ প্রতিবেদন

এক সময় অপ্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন এই সৎ মানুষটি– আজ তাঁর জন্মদিন

সততা ও অসততার প্রশ্নে প্রফুল্লচন্দ্র সেন

তমাল সাহা

বয়সের এই প্রান্তিক বেলায় বর্ষ যখন শেষ হয়ে আসে তখন আজ হঠাৎ এই মানুষটির কথা মনে পড়ে গেল। ভেসে উঠলো সেই রসময় ছড়াটি— এক আনা সের বেগুন কিনে মনটা হল প্রফুল্ল/ বাড়িতে গিয়ে দেখি সবই কানা অতুল্য।এই ছড়াটি তখন গাঙ্গেয় উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়েছিল এবং আমাদের মুখস্থ ছিল।তখন এই বঙ্গদেশে তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন এবং কংগ্রেস সভাপতি দৃষ্টিহীন অতুল্য ঘোষ।

তখন কৈশোর পেরিয়ে আমাদের তারুণ্য ছুঁই ছুঁই। এখন এই মহা-নীতিভ্রষ্ট কালে বঙ্গপ্রদেশ দুর্নীতির আখড়া হয়ে গিয়েছে, ঘুষ শব্দটি আকাশে বাতাসে ফিরছে, চোর চোর আওয়াজের শব্দ দূষণে বায়ুমণ্ডল পূর্ণ হয়ে গিয়েছে তখন তোমার কথা মনে পড়ে। এখন শিক্ষা দপ্তরটাই কারাগারে, চাকরি থেকে প্রতারিত করে প্রজন্মের রক্ত পান করছে শাসক। চোরের মায়ের বড় গলা– এই প্রবাদটি এখন সত্যে পরিণত।

রাজনৈতিকভাবে তোমাকেও অসৎ বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছিল। এখন বুঝি তুমি কিছুতেই দুর্নীতি পরায়ণ অসৎ ছিলে না। এমনকি সরকারি দয়া-দাক্ষ্যিণ্যের বিন্দুমাত্র তুমি গ্রহণ করোনি। তুমি নাকি স্টিফেন হাউস কিনে নিয়েছো এমন মিথ্যা ও কুৎসা প্রচারে আমরা যুগপৎ উত্তেজিত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলাম। হায়, রাজনীতি! কতই না কদর্য পথ অবলম্বন করে নিজেদের ক্ষমতায়নের জন্য, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য।

তখন মূলত খাদ্য সংকটনের কারণে তোমার পতন ঘটে গেল। রেশন ব্যবস্থা চালু করেও সামাল দিতে পারলে না তুমি। ‘ভাতের বদলে কাঁচা কলা খান’। সঙ্গে বলেছিলে, এটাও কার্বোহাইড্রেটের বিকল্প এবং দামে সস্তা ফাইবারযুক্ত। এই স্লোগানটি পতন সূচক হয়ে দাঁড়ালো। ৩০ বছরের কংগ্রেসী শাসনের সূচনা করলো। শুরু হলো ৬৬ ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন। এই আন্দোলন কলকাতা, উত্তর চব্বিশ পরগণার বারাসাত বসিরহাট, নদীয়ার কৃষ্ণনগরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। শহরতলির কংগ্রেস নেতারা এলাকা ছেড়ে কলকাতায় পালিয়ে আসছে বাধ্য হয়েছিলেন। পুলিশের গুলিতে নিহত আন্দোলনকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। তৈরি হলো স্লোগান– দমদম ডুবুডুবু/ কৃষ্ণনগর ভেসে যায়। নির্বিচারে পুলিশের গুলিবর্ষণে বসিরহাটে নিহত হলেন নুরুল ইসলাম, বাদুড়িয়াতে আলী হাফিজ কালু মন্ডল, বেহালাতে সুখেন মুখার্জি, খড়দডহে বাবলু দাস, কৃষ্ণনগরে আনন্দ হাইত, কোন্নগরের রঞ্জন দত্ত, শ্রীরামপুরে নারায়ণ সাধুখাঁ প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ।

তোমার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এই অপশাসনের প্রতিশোধ নিয়েছিল মানুষ। সেটা ছিল ১৯৬৭ সালের নির্বাচন। বাংলা কংগ্রেসের নেতা এক সময়ে তোমার সহযোগী অজয় মুখার্জির কাছে ৮২০ ভোটে পরাজিত হয়েছিলে তুমি। নিশ্চিত এই ঘটনা তোমার রাজনৈতিক জীবনে কলঙ্ক লেপন করেছিল।

তুমি পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ছিলে, ছিলে অকৃতদার। ১৯২১-এর অসহযোগ আন্দোলন, ১৯৪০-এর সত্যাগ্রহ আন্দোলন, ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ছিলে তুমি। তুমি নারী শিক্ষা প্রসারে আরামবাগ বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করেছিলে। ১৯৩০ থেকে ১৯৪২ বার বার জেল কুঠুরিটিতে বন্দী থেকেছো।

১০ এপ্রিল,১৮৯৭ থেকে হাঁটতে হাঁটতে ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯০ দাহঘাটে পা রাখলে তুমি। হা! হা!গান স্যালুট?

সর্বৈব মিথ্যাচারিতা ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক আখড়ায় পরিকীর্ণ এই সময়ে তোমার কথা মনে পড়ে। তোমার মৃত্যুকালে শবযাত্রায় কজন লোক হয়েছিল কড় গুণে বলা যায়। অন্তিম প্রহরে তোমার ওই ছোট্ট মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুতে তোমার যাবতীয় ঐশ্বর্য ও সম্পদ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল– চার জোড়া ধুতি এবং একটি বইয়ে ঠাসা আলমারি।