এই শীতের বেলায় মোহনলালের সঙ্গে কথা

এই শীত ও মোহনলাল
তমাল সাহা

হেমন্তের বেলা ছোট হয়ে আসে।
বিষাদের রং মেখে সূর্য নেমে পড়ে জলে। হিম ঝরতে শুরু করে।
মোহনলাল রিক্সাওয়ালার রুজিতে কমতি পড়ে।
সে লুঙ্গি পরে রিকশা চালায়। বয়সের ভার বাড়ছে। রিকশা টানতে একটু কষ্ট হয়। যাত্রী বলে ওঠে, এত আস্তে চালাও কেন? ট্রেন তো ফেল হয়ে যাবে! তখন সে আর কী করে? সীট ছেড়ে শরীরটা একটু উঁচু করে মানে পেছনটা একটু উঁচুতে উঠিয়ে জোর দিয়ে প্যাডেলে চাপ দিতে থাকে‌। রিক্সার চাকাগুলো দ্রুত চলতে থাকে আর তার শরীর একবার বাম দিকে একবার ডানদিকে নাচতে থাকে।

মোহনলাল সুন্দর কথা বলে। আমাকে বলে, আমাদের তো দুটোই দিক। বামদিক আর ডানদিক। আমরা মাটির ভিতরেও সেঁধিয়ে যেতে পারি না আবার উপরে মানে উঁচুতেও উঠতে পারিনা।

হাওয়ারা তো ঠান্ডা বয়ে বেড়ায়, এদিক ওদিক শীতল বাতাস নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে ওদের ঠাণ্ডা লাগে না। হাওয়াদের চাদর লাগে না। কী আশ্চর্য! ওরা ঠাণ্ডা শুষে নিয়ে রিকশাওয়ালার গায়ে ছুড়ে দেয়!

মোহনলালকে আমি রোজ দেখি। অনেকদিনের পুরনো হাওয়াই চটি পরে রিক্সা চালিয়ে ডাঙ্গাপাড়া শহিদনগর লিচুবাগান মিলননগর আগুরিপাড়া বাগমোড় কখনো বা ভূতবাগান চলে যায়।

ফুটপাতের পাশে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে পুরানো ব্যবহৃত উলের জামা কাপড়।
মোহনলাল সেখান থেকে আজ একটি মাঙ্কি টুপি কিনে নিয়েছে।কানের উপরের দিকে একটু ছেঁড়া। তুতে কালারের মাঙ্কি টুপি।
আমি বলি, এ রংটা পছন্দ হলো তোমার!
সে বলে, জীবনটা পিত্তির মত তুতে রঙের হয়ে যাচ্ছে,তাই!
আমি বলি একটা সোয়েটার না কিনে টুপিটা কিনলে কেন আগে? ও চুপ করে থাকে।

আমি বলি, তুমি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পাও? ও বলে, আমার লক্ষ্মী সেবার করোনায় মরে গিয়েছে। তাকে পোড়াতে গিয়ে খুব ঝামেলায় পড়েছিলাম।

তুমি থাকো কোথায়?
ওই তো কবরস্থান ময়দানে, বটগাছের পাশে একটা ঝুপড়ি বানিয়েছি তাতে।
তোমার ছেলে মেয়ে আছে?দুটো। হরিজন স্কুলে পড়ে গান্ধীজি হরিজন ইস্কুল। আপনি দেখেননি, ওই যে আম্বেদকরের মূর্তি বসানো আছে ইস্কুলের সামনে। দুদিকে মেথর পাড়া। শুয়োরেরা চড়ে বেড়াচ্ছে।

মোহনলাল বলে, খুব ঝামেলা হয়ে গিয়েছে।
আমি বলি,ঝামেলা মানে? রোজগারপাতি কমে গিয়েছে। টোটো গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে তো! অনেক রিক্সাওয়ালা লিজ নিয়ে টোটো চালাচ্ছে। সবাই এখন বাবুবিবি হয়ে গিয়েছে, কেউ আর রিক্সা চড়তে চায় না।

আমি বলি, মেনে নিতে হবে যুগের হাল।
ও বলে, আমাদের পেটের হালের তো কোনো চেঞ্জ হয় না!
এর কোনো উত্তর জানা নেই আমার। এর একটাই উত্তর নিশ্চুপ থাকা।

এরপর একদিন ছেলেমেয়েদের দুটো সোয়েটার কিনে দেবো। তারপর আমার জন্য একটা ফুলহাতা সোয়েটার কিনবো।
আমি বলি, খুব ভালো কথা।

কোনো ঋতুতে গা বেয়ে দরদরে ঘাম, কোনো ঋতুতে বৃষ্টির জলে ভেজা, কোনো ঋতুতে শীতকাতুরে হয়ে পড়াই মোহনলালের জীবন।

মোহনলাল বলে, রিক্সা দিয়ে জীবন মাপি আমি।
বলি, কিরকম?
সে বলে,জীবনে জন্ম মৃত্যু বিয়ে আছে। রিকশারও তিনটে চাকা বা আপনি বলতে পারেন শৈশব যৌবন বার্ধক্য। জীবনে এ তিনটে ঘুরবেই। রিকশাতে তো চেইন আছে। এই চেইন না ঘুরালে কি চাকা এগোবে? এই বন্ধনেই জীবন এগোয়। জীবন রাস্তার মতো। কখনো এবড়ো খেবড়ো, কাদা মাটির কখনো বা সমতল। এসব পেরিয়ে রিক্সার মতো জীবন চলে। আর হর্ন তো থাকবেই। না হলে মানুষের পাশে থাকবেন কি করে, কি করে হর্ন বাজিয়ে হুঁশিয়ারি দেবেন? জীবনের শেষ বাঁশিতে স্পেশাল হর্ন বাজবে!
আমি শ্বাস ফেলে বলি, কী বলছো মোহনলাল! আমি তাকিয়ে তার ভাঙাচোরা মুখ দেখি।

কথাবার্তার পর একটা নীল সুতোর বিড়িতে জোর টান দিল মোহনলাল।
বয়স হয়েছে। এখন আর বিড়ি ফুঁকোনা, মোহনলাল।

মোহনলাল বলে, এটাকে সুখটান বলে। এই বলে, সুখ ভর্তি এক রাশ ধোঁয়া উড়িয়ে দিল আকাশে।