পর্ব–২
চলো গো সতীমার মেলা!

অবতক,১৩ মার্চঃ
ভবের হাটে এ কোন্ দোকানদার!
পরনে জোব্বা আলখাল্লা
হাতে বিশাল দাঁড়িপাল্লা
কিবা তার মন
মানুষ করে চলেছে ওজন
কে কুজন, কে গো সুজন!

পৃথিবীর অপূর্বতম ও আশ্চর্যতম শব্দ
‘মা’, যা একটি মাত্র শব্দে উচ্চারণ তা অর্জন করেছে একমাত্র বাংলা বর্ণমালা। একটি শব্দে মায়ের এই স্বাগত উচ্চারণ পৃথিবীর আর অন‍্য কোনো ভাষায় নেই। মা,এমন একটি শব্দ যারমধ্যে রয়েছে সুদূরপ্রয়াসী বিস্তারের আয়োজন। মা…আ… আ… আ…, অদ্ভুত এই প্লুতস্বর বাতাসে ভেসে যায়। মা তো একটি শব্দ,তার আগে যদি সতী শব্দটি বসে যায় তবে অপার্থিব উচ্চমার্গীয় সুষমা পেয়ে যায়। দুনিয়ার সব মা-ই সতী। তিনকড়ি বালা,মাতঙ্গিনী হাজরা, পাভেলের মা, আমার মা, তোমার মা সকলেই সতী—সতীত্বের আধার। মাতৃগর্ভের অন্ধকারে আমাদের লালন করে পৃথিবীর অন্যতম আলোকবর্তিকা সূর্যটিকে দেখায় তাঁরা। তাঁদের প্রণাম।
মনফকিরা বলে—
পরে তো আছিস এই দেহ-জামা!
মাটি নাহলে কোথায়রে মা!
মা! মা! করে ডাকিস কারে?
তোর পাশেতেই আছে নারী
সেই তো তোর মা হবে—
দেখরে মন!মেতেছে খেলায়
রূপসাগরে বাইছে তরী।

আমাদের কল্যাণীর সতীমা হলেন সরস্বতী দেবী। আউলিয়া রামশরণ পালের সহধর্মিণী। ঘোষপাড়ার পূর্ব নাম ডুবোপাড়া,এর নাম হয়ে গেল ঘোষপাড়া। ফকির ঠাকুরের ঘোষণায় এটি ডুবোপাড়া থেকে ঘোষপাড়া হয়ে যায়। তবে প্রশ্ন,ডুবোপাড়া কেন? সেখানে কি কেবলমাত্র ডোবাই ছিল? অথবা অঞ্চলটি অন‍্যায়,অসংস্কৃতিতে ডুবে ছিল? সেটা কেন হয়ে গেল মানব মিলন ঘোষণার ঘোষপাড়া? তা কেউ জানে না। এখানে কি ঘোষেদের বসতি ছিল অত্যধিক? এসব গবেষকদের বিষয়।

আউলিয়া শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে আকুলতা যা সর্বজনীন এবং সার্বজনীন। এর সঙ্গে জড়িত ভেদহীন মানবিক মাঙ্গলিকতা।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মহাতীর্থস্থান ঘোষপাড়া তো বটেই। সতীমার মেলাও এক মহামিলন ক্ষেত্র। কর্তা কথার অর্থ ঈশ্বর। যিনি আসলে ঐশ্বর্যবান। এই ঐশ্বর্য হৃদয়ের ঐশ্বর্য।

১৭৫৬ সালে আউলচাঁদ আসেন ঘোষপাড়ায়। সেখানে তখন বাইশের হাট। তাঁর প্রধান শিষ্য ছিল ২২ জন। অন্যতম ছিলেন রামশরণ পাল। এঁরা আউলিয়া নামে পরিচিত। কর্তা ভজা সম্প্রদায়ের শিষ্যরা বরাতি নামে পরিচিত। বরাতি-র মানে? বরাত আছে যার, যিনি ভাগ্যবান। কর্তা ভজা সম্প্রদায়ের যারা ভক্ত, যিনি অন্ধকারে আলোক দেখান তাকে বলা হয় গুরু। গু মানে অন্ধকার,রু মানে আলো।‌তিনিই গুরু,তাঁকে ভক্তরা বলেন মহাশয়। মহান আশয় যিনি।

আর ১৭৮৪ সালে যতদূর জানা যায়,এই কর্তাভজা সম্প্রদায়ের দায়িত্ব পান সরস্বতী দেবী। সতীমা। তিনি নাকি বাক-সিদ্ধ নারী। _ সত‍্যকে ধারণ করেছেন বলেই তিনি নাকি অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারতেন।

আমাদের এসব অলৌকিক কথার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রয়োজন লৌকিকতা। মানুষ মানুষের মিলন,আর সেই মিলনই হয় ঘোষপাড়ার মেলায় দোল পূর্ণিমার দিন। এপার-ওপারের বাউলরা আসেন গান গাইতে। সে গান দেহতত্ত্বের গান। মানব মিলনের গান।সে গান শরীরকে অশরীরী করবার গান—
আপন তো আপণরে
বেঁচে দে তুই আপনরে।
যে কিনবে তোরে অমন দরে
বুঝবে রসদ কোন ঘরে?

জীবনে যে রং আছে,ছন্দ আছে সেইজন্যই তো দোল পূর্ণিমায় রঙের বর্ণময় ধারা নিয়ে আবীরের ফোয়ারা নিয়ে মেতে ওঠে ঘোষপাড়ার মেলা। মন! মন রে! তোর কোথায় লুকিয়ে আছে এত রং!! মিলনের এই মহাকারবার দেখে মন-বাউল বলে ওঠে—
দুজনাতেই মুখোমুখি
এ দেখে,ও দেখে
দেখার সুখে মেলায় আঁখি।
কে নর,আর কে নারী?
বুকের উপর দুধের হাঁড়ি।
নিচে তার আঁতুড় ঘর
নারীর ভিতর লুকিয়ে নর।

আমরা মানুষ বটে, আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভড়ং এবং সঙ্।চল্ তাঁর সঙ্গ করি। সে হবে তোর-আমার সঙ্গী।কে সেই আসল সঙ্গী? কাঞ্চনপল্লী, কল্যাণী, ঘোষপাড়া তা জানে। ওরা আজীবন মনকে খুঁজে চলে। ওরে মন! রাঙিয়ে দে আমাদের মন—
চল! ডালিম তলে যাই,
মন-মাটির ঘোড়া বাঁধি ভাই।
ডালে ডালে আমি তুমি
ডালের তলে এ কোন্ ঘরামি!

আর তার পর?
উপরে আকাশ,শূন্যে বাতাস
বাঁশিতে সুর জীবন-শ্বাস
বাঁশে শুয়ে দেহ-লাশ।
এই যে তোর জীবন পাখি
ফুড়ুৎ করে যাবে উড়ে,
মুদবে আঁখি।