মণিদিকে দেখিনি, তার কথা শুনেছি

তমাল সাহা 

এই খড়্গধারী ছিন্নমস্তা সময়ে যখন কালরাত্রির অন্ধকার নেমে আসে তখন এইসব তেজি দস্যি নারীদের মুখ মনে পড়ে। মুখগুলি ক্রমাগত পরিণতিতে আমার মা, আমার দেশ, আমার মাটি, আমার জন্মভূমি হয়ে দাঁড়ায়। আমি বারবার দেখি এই মুখ। এই মুখগুলিকেই তো আসলে বলা হয় রূপসী বাংলার মুখ।

সেই মেয়েটা, মণিকুন্তলা সেন, সবাই ডাকতো মণিদি, তিনি আমাদের গর্বিত অহঙ্কার। ব্রিটিশ চালাচ্ছে শাসন। দুর্ভিক্ষ চলছে। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়া হল। সমিতির সম্পাদিকা হলেন এলা রিড। আর সহ সম্পাদিকা হলেন এই আগুনখোর মেয়ে মণিকুন্তলা সেন।

সে সময়ের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন এই মেয়েটির হিম্মত কতখানি। খাদ্যের দাবিতে এ্যাসেম্বলি দেখার কার্ড হাতে করে পাঁচ হাজার মহিলা নিয়ে ভুখা মিছিল করে ঢুকে গিয়েছিলেন বিধানসভা ভবনে। এই মেয়ের একগুঁয়েমিতে সেদিনই দু সের করে চাল বরাদ্দ করতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রত্যেক বিক্ষোভকারীর জন্য মুখ্যমন্ত্রী সাহেব। এই আন্দোলনের জেরেই কলকাতায় খুলতে বাধ্য হয়েছিল সরকার ১৬টি ন্যায্য মূল্যের দোকান। আজ আপনারা যাকে বলেন রেশন শপ।

এই একরোখা মেয়েটি বারংবার কাঁচরাপাড়ায় এসেছেন, মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি সংগঠনের কাজে। এসে উঠেছেন রজনী বাবু রোডের সবিতা চ্যাটার্জীর বাড়ি। তখন সবিতা চ্যাটার্জী, মান্ধারী বাজার কোয়ার্টারের প্রমীলা নিয়োগী, সতীশ নন্দী বাই লেনের গীতা মুখার্জী, কৈশোর উত্তীর্ণা বিমলা সেনগুপ্ত, বিল্ব ভট্টাচার্যরা সেই সমিতির সদস্য।

কংগ্রেসী জমানা। ২৭ এপ্রিল, ১৯৪৯ সাল। বিভিন্ন গণ আন্দোলন চলছে। তখন তো অগ্নিক্ষরা সংগ্রামের দিন। বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে লড়াকুরা জেলে বন্দি। ইতিমধ্যে দমদম জেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়ে গিয়েছেন কৃষক কর্মী প্রভাত কুন্ডু ও ছাত্র সুশীল চক্রবর্তী। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে ২৭ এপ্রিল, ১৯৪৯, বউবাজার-কলেজ স্ট্রিট ক্রসিং-এ এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে সক্রিয় অংশ নেন নারীরা। তারা হুগলি, হাওড়া, ২৪ পরগনা, সুদূর পল্লীগ্রাম থেকে অংশগ্রহণ করতে আসেন তাতে ছিল বস্তিবাসী, ভিটেমাটিহারা নারীরা। সেই সমাবেশে বিনা প্ররোচনায় গুলি চালায় পুলিশ। তাতে শহিদ হন মণিকুন্তলা সেনের হাতে গড়া মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্যা অমিয়া, প্রতিভা, গীতা, লতিকা।

উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে এই আহত জখমি মায়েদের পাশে এসে দাঁড়ান বৌবাজারের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা আহতদের আশ্রয় দেন, চিকিৎসার জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন,গভীর রাত পর্যন্ত প্রতীক্ষা করেন, এমনকি আহতদের বাড়ি পৌঁছে দেন। এ এক বাংলার উজ্জ্বল ইতিহাস।

মণিদি এই সেদিন স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ১৯৪৯ সালে খড়্গপুরে শ্রমিক সমাবেশে, জয়প্রকাশ নারায়ণের ভাষণে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন শ্রমজীবী নারীদের দুঃখের কথার অভিযোগ করতে, উত্তর চেয়েছেন নেতাদের কাছ থেকে।

জয়প্রকাশ কি বলেছিলেন সেদিন? ‘তাহলে আপনিই বক্তৃতা দিন। আমি মঞ্চ থেকে নেমে পড়ি।’ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মণিদি। রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা চেয়েছিলেন। নিজের ছদ্মনাম রেখেছিলেন ‘বীণা দাস’।

মণিদি জন্মেছিলেন ১১ ডিসেম্বর, ১৯১০। চলে গিয়েছেন ১১ সেপ্টেম্বর,১৯৮৭। কম্যুনিস্ট ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন অন্যতম কমিউনিস্ট নেতা জলিমোহন কাউলকে। মণিদি আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন– ‘সেদিনের কথা’ বইটি ইংরেজিতে ‘ইন সার্চ অফ ফ্রিডমঃ অ্যান আনফিনিশড জার্নি’।

তার বইটি পুরো না পড়লেও শেষ অধ্যায়টি পড়ে নিতে পারেন। সেখানে লেখা আছে নারী স্বাধীনতা, দাম্পত্য সম্পর্ক, শিশু পালন ও পরিবার, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কথা এবং সমাজতন্ত্রে নর নারী সম্পর্ক।