এই যুদ্ধাঙ্গনে ভালোবাসার চুম্বন আর স্যালুট ছাড়া তোমাদের কি দিতে পারি?

ঘটনাঃ এপিসি ভবনের সামনে অবস্থান। ১৭ অক্টোবর ২০২২

ফুটপাথ থেকে ক্লাসরুমে 

তমাল সাহা

মা কৈলাসে ফিরে গেছে। নীলকন্ঠ পৌঁছে দিয়ে গেছে আগাম সংবাদ। শিব উত্তেজনায় ভরপুর। বসে আছে কৈলাসে একটা চওড়া উঁচু পাথরের উপর। উমাকে পাশে বসিয়ে স্বাগত জানাবে।

গাঙ্গেয়প্রদেশ জুড়ে ৬০ হাজার টাকার জমজমাটি প্যান্ডেল। জাঁক হয়েছে খুব। কোথাও টুইন টাওয়ার, কোথাও দিল্লির লালকেল্লার মতো মায়ের মন্ডপ। মা চার দিন পেটপুরে খেয়েছে। আবার এক বছর পর আসবে বলে কথা দিয়ে গেছে।

বাপের বাড়িতে এসেছে। মা ষও বিসর্জনে ব্যস্ত ছিল বলে খরাস্রোতা মাল নদীতে আটজন জীবন্ত লাশের ভাসান দেখতে যেতে পারিনি।

তাই মা খুব কেঁদেকেটে গেছে!

তবে বেলতলায় বোধনের দিন থেকে নবমী পর্যন্ত প্যান্ডেল ছেড়ে মা বেরোয়নি।মায়ের বয়স হয়েছে। পাহাড় থেকে সমতল রাজনৈতিক মিছিল হতে পারে কিন্তু মায়ের এতটা পথ হেঁটে আসা পোষায়? হাঁটুতে ক্ষয়রোগ ধরা পড়েছে। মায়ের বোধ করি বাপের বাড়ির উপর ঘেন্না ধরে গেছে। সে আর পথে-ঘাটে ছেলেপুলেদের দুরবস্থা দেখতে বেরোতে চায় না।

তবে জেনে গেছি প্রতিমূর্তি বানানোর আসল কারণ। গান্ধীজী-মাতঙ্গিনী পাথরের প্রতিমা হলে কি হবে তাদের প্রাণ আছে। তারা প্রজন্মদের আশ্রয়। সেখানে ন্যায্য দাবি আদায়ের অবস্থানে বসেছে মায়ের উত্তরপুরুষেরা। ওরা দুবছর মায়ের মুখ দেখেনি। মাও ওদের দেখতে যায়নি। ওরা লড়াই করছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিস্তৃতি বাড়ছে। ওরা এখন এ পি সি ভবনের সামনে লড়াই করছে। সে এক দুর্ধর্ষ লড়াই। পুলিশি হামলায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে আন্দোলনকারী অনেক ছাত্র-ছাত্রী।

মা এসে চলে গিয়েছে। মাও একদিন লড়াই করেছিল তাও সশস্ত্র লড়াই। মা লড়াই করেছিল মহিষাসুরের বিরুদ্ধে। ওরা লড়াই করছে রাষ্ট্রাসুরের বিরুদ্ধে। মা লড়াইয়ের পথ ভুলে গেছে কিন্তু প্রজন্মেরা ভোলেনি তারা সশস্ত্র লড়াই নয়, তারা অহিংস লড়াই করছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ভবনের সামনে। এখন দুর্ধর্ষ লড়াই চলছে। সারারাত চলছে সেই লড়াই।

রাত্রির গভীরতর অন্ধকারে স্মার্টফোনের টর্চ জ্বালিয়ে আলোয় জেগে থাকছে ওরা। মাঝেমধ্যেই দেখে নিচ্ছে সেই আলোতে সহযোদ্ধা প্রতিবাদীদের মুখ।

এ লড়াই জীবন জীবিকার। আচার্যের তো এমনিতেই বিশীর্ণ চেহারা, উসকোখুসকো চুল। সেই ভাঙা অবয়বেই তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।

হেমন্ত এসে গেছে। ঝরা পাতার অরণ্যে হিমেল বাতাস বইছে। সল্টলেকের রাস্তার ধারের বৃক্ষগুলি থেকে কিছু পাতা ঝরে পড়ল। প্রচণ্ড শীতের কামড় সবই সইতে হবে প্রজন্মদের। তারা বসন্তের প্রতীক্ষায় আছে।

বসন্ত ও বাসন্তিকারা ফুটপাত ছেড়ে ক্লাসরুমের দিকে যাবে একদিন। ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। ডান হাতে থাকবে চক পেন্সিল, বাঁ হাতে থাকবে ডাস্টার–কালো বোর্ডে সাদা অক্ষরে বোঝাবে পাঠের বিষয়, পাঠের সঙ্গে জীবন কতটা সম্পৃক্ত। আর বারবার মাথা ঘুরিঊ তাকাবে প্রিয় শিক্ষার্থীদের মুখগুলির দিকে…