অবতক খবর,১০ জুলাই: আজ কাঁচরাপাড়া ওয়ার্কশপ রোড বর্তমানে লেনিন সরণিতে যে রাণী প্রেসটি রয়েছে তার প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য্য প্রয়াত হলেন। আজ বেলা সাড়ে বারোটায় তিনি প্রয়াত হন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেলেন তাঁর প্রজন্ম পাঁচ পুত্র।

উল্লেখযোগ্য, কাঁচরাপাড়ার মুদ্রণ জগতে অর্থাৎ প্রেসের অগ্রণী কারিগর হিসেবে বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য্যের নাম সুবিদিত। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বীজপুর অঞ্চলে বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য্যকে যারা চেনেন না তারা কাঁচরাপাড়াকেই জানেন না। মুদ্রণ শিল্পে তাঁর দক্ষতা এবং নৈপুণ্য এক কিংবদন্তি।

ওয়ার্কশপ রোড স্থিত যে রাণী প্রেস তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সেটির সময়কাল ১৯৫৬।
তবে পূর্বে এই প্রেসটি বাণী প্রেস নামে পরিচিত ছিল।

বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য্যের পরিচিতি একজন রসজ্ঞ মানুষ হিসেবে। কলকাতা যাত্রাপথে ট্রেনে বিশ্বনাথ বাবুর যে রসময় আলোচনা তা ছিল মনোগ্রাহী। তাঁর পাশে বসবার আসনটি সংগ্রহ করার জন্য যাত্রীদের মধ্যে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে যেত।

বিশ্বনাথবাবু স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং মহাত্মা গান্ধীর যে লবণ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল সেই সময়ে এই অঞ্চলে যে তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল সেই সত্যাগ্রহ আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ‌তিনি হরিজন আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। ‌তাঁর সদালাপী ব্যবহার, আচার-আচরণ উল্লেখযোগ্য ছিল। তাঁর চেহারার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। তাঁর চোখের ভ্রু পল্লব এমনই দীর্ঘ ছিল যে তা পাকানো যেত। তিনি মাঝেমধ্যেই গাড়িতে উঠে সবার সামনে ছিল পল্লব পাকাতেন এবং মজা করতেন। তিনি রম্য রচনার সংকলনও প্রকাশ করেছিলেন। সেই সংকলনটির নাম “বিশু বাবুর কথা আর গল্প”।

কাঁচরাপাড়ার যে রাজনৈতিক মহল সেখানেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন।‌ কাঁচরাপাড়া এবং বীজপুরের বিধায়ক সিপিএম দলনেতা জগদীশ দাসের সঙ্গে তাঁর সখ্য তো ছিলই, তিনি অবসর কাটানোর জন্য তিনি এবং জগদীশ দাস মাছ ধরতেও যেতেন কাঁপার সুদূরবর্তী অঞ্চলে।

তিনি জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন ১৯২৫ সালে মগরাহাটে। তাঁর পিতা খগেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য এবং মাতা সরলাবালা দেবী। পুরোহিত হিসেবে তাঁর বাবা অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন এই অঞ্চলে। এই অঞ্চলের তিনি একজন প্রাচীন পুরোহিত ছিলেন। ‌

বিশ্বনাথবাবু কাঁচরাপাড়া অঞ্চলের অনেক পুরনো কথা জানতেন। তা তিনি অনর্গল বলে যেতে পারতেন। এমন একজন সুপরিচিত মানুষ আজ প্রয়াত হলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৯৫ বছর।

উল্লেখযোগ্যভাবে নভেম্বর বিপ্লব মাসে স্থানীয় জননেতা অমূল্য উকিলের যে জন্ম শতবর্ষের অনুষ্ঠান লেনিন সরণী স্হিত পৌরসভার মুক্ত প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন এবং অমূল্যবাবুর মানুষের প্রতি রাজনৈতিক কর্তব্য, পৌর চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর যে কর্তব্যবোধ, তিনি যে কাঁচরাপাড়াবাসীর প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন,সেসব কথা তিনি বিস্তৃতভাবে বলেন। অর্থাৎ বীজপুর অঞ্চলে বিশেষ করে কাঁচরাপাড়ায় অতি দীর্ঘ বয়স্ক মানুষ হিসেবে তিনি চলে গেলেন। এই ৯৫ বছরে তাঁর প্রয়াণ কাঁচরাপাড়ার নাগরিক জীবনে একটি ইতিহাস হয়ে রইল।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে তাঁর অনুরাগ ছিল প্রবল। তিনি এক আলোচনা সভায়,তাঁর সহযোগীরা যেখানে উপস্থিত তিনি বলেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশের কথা,ফজলুল হকের কথা। তাঁর মুখ থেকে এমন অনেক গল্প আমরা শুনেছি। ‌তিনি বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর অনুরক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশের ভক্ত। নেতাজীর সহযোগী সুশীলকুমার ঘোষের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি বলেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশের একটি বক্তৃতার কথা। তিনি বলেছিলেন যে, চিত্তরঞ্জন দাশ বলেছিলেন যে, স্বাধীনতা হল গুড়ের কলস। গুড়ের কলসে যাতে পিঁপড়ে না ধরে তার জন্য একটা জলপূর্ণ পাত্রে রেখে দেওয়া হয়। ‌পিঁপড়েরা সেই জলে পড়ে সাঁতার দিতে দিতে গুড়ের কলসের কাছে যেতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ গুড়ের কলসের কাছে যাওয়া অত সহজ নয়। ‌ স্বাধীনতাকে তিনি গুড়ের কলসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ‌পিঁপড়েদের সংগ্রামীদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমেই যে স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব সেটি তিনি এই দৃষ্টান্ত সহকারে বোঝাতে চেয়েছিলেন। এই বক্তৃতা তিনি শুনেছিলেন বলে আমাদের জানিয়েছিলেন।

কাঁচরাপাড়ার রসিক- রসরাজ বলতে একজন মানুষ ছিলেন এবং তাঁর মানুষের সঙ্গে মেশার অদ্ভুত গুণ ছিল,তেমন একটি মানুষকে বিশেষ করে কাঁচরাপাড়া আজ হারালো।