কাঞ্চনপল্লীর রথ, চৈতন্যদেব ও কৃষ্ণরাইজির মন্দির

তমাল সাহা

প্রেমের ধারা বহিছে ভুবনে/ প্রেম ছাড়া আর কী আছে জীবনে!

ভারতবর্ষের ভৌগোলিকে শ্রীচৈতন্যদেব ঐতিহাসিক। বাংলার জীবনচর্চায় তিনি নিশ্চিত লৌকিক।
জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই কাছের মানুষ তিনি।

এ তো এখন লোকমুখে প্রচারিত প্রবাদমূলক গান হয়ে গিয়েছে— মেরেছো মেরেছো কলসির কানা/ তাই বলে কি প্রেম দেব না? এই মানব সন্তান এই জনপদে এসেছিলেন আমাদের এই জনপদের উল্লেখযোগ্য কবি সেন শিবানন্দের বাড়িতে।
শিবানন্দ সেনের সুযোগ্য পুত্র
কবি কর্ণপুর ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটক’ এবং ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত মহাকাব্য’ লিখে গিয়েছেন। সেখান থেকে জানা যায় যে কাঞ্চনপল্লী কুমারহট্টে শ্রীচৈতন্যদেব এসেছিলেন নীলাচল থেকে নৌপথে ফিরবার পথে। প্রথমে পানিহাটি, দ্বিতীয়তঃ
কুমারহট্টের খাসবাটী অঞ্চলে শ্রীবাস পণ্ডিতের বাড়িতে অবস্থান করেন। এরপর তিনি চৈতন্যডোবাস্থিত(বর্তমান) শ্রী ঈশ্বর পুরীর ভিটায় পৌঁছান। তারপর তিনি কাঞ্চনপল্লীতে কবি শিবানন্দ সেনের বাড়িতে অতিবাহিত করেন। জানা যায় চৈতন্যদেব ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দের কার্তিক মাসের ত্রয়োদশী চতুর্দশী বা অমাবস্যায় শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহ, ঈশ্বরপুরীর ভিটা এবং পরবর্তীতে শিবানন্দ সেন-বাসুদেব দত্তের গৃহে এসেছিলেন। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র দে ‘কাঞ্চনপল্লী ঐ গৌরাঙ্গদেব’ গ্রন্থে এমনই উল্লেখ করেছেন।

সে যাই হোক কাঞ্চনপল্লী বর্তমানে কল্যাণীর শ্রীকৃষ্ণ রাইজির মন্দির ও রথতলার রথের সঙ্গে শ্রীচৈতন্যদেব জড়িয়ে রয়েছেন।

কল্যাণী রথতলার রথ দেড় শতাধিক বৎসরেরও অধিক প্রাচীন। এই রথ তৈরি করেন এই অঞ্চলের জমিদার বীরেশ্বর নন্দী। জনশ্রুতি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনি এই রথ নির্মাণে ব্রতী হন। জমিদার বংশের এক পূর্বপুরুষ তাকে শ্রীকৃষ্ণরাইজির মন্দির সংলগ্ন বিশাল অঞ্চলে একটি রথ উৎসব আয়োজন নির্দেশ দেন। এই রথটি পূর্বে কাষ্ঠ নির্মিত ছিল। পরবর্তীতে এই রথটি লৌহদ্বারা পুনর্নিমিত হয়।
জানা যায় কোন কারণে এই কাষ্ঠরথটি অগ্নিদাহে ভস্মীভূত হয়। আবার কেউ মনে করেন কোন দুর্যোগের রাতে পথ চলতি এক নারী আশ্রয় না পেয়ে এই রথে আশ্রয় নেন। তিনি আসন্ন প্রসবা ছিলেন। কোন স্থানের সন্ধান না পেয়ে এই রথে আশ্রয় নিয় সেখানেই তিনি প্রসব যন্ত্রণায় সন্তান প্রসব করেন। ফলে পদে রক্তে
অশৌচে পরিণত হয়। তাই শুদ্ধতা রক্ষার্থে এই রথটি লৌহ দ্বারা পুনর্নির্মিত হয়
জানা যায় প্রাচীন কাষ্ঠরথে কৃষ্ণরাইজি মন্দিরের কষ্টিপাথরের বিগ্রহটি এই রথে স্থাপন করা হতো। বিগ্রহটি ভেঙে যেতে পারে এই আশঙ্কায় ওই বিগ্রহের অনুকরণে মাটির বিগ্রহ স্থাপন করা হয়।

এই রথটি ত্রিতল। প্রথম তলে থাকেন জগন্নাথ। দ্বিতীয় তলে থাকেন কৃষ্ণরাইজির মূর্তি। তৃতীয় স্তরে স্থাপন করা হয় বলরামের মূর্তি। রথটি উচ্চতায় ১৫ ফুট। চূড়ায় থাকে পাঁচটি ধ্বজা। রথের রশিটির দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট। রথটি
লোহার শেকলের সঙ্গে বাধা।রথ চালানোর সঙ্গে যুক্ত ছটি কাঠের ঘোড়া ও একজন সারথি।

কৃষ্ণরাইজির মন্দিরে পুরাতন স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন রয়েছে। ১৭৮৫ সালে এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার ধনবান ব্যক্তি নয়ানচাঁদ মল্লিকের দুই পুত্র নিমাইচরণ ও গৌরচরণএই মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। তারা পূর্বে কাঞ্চন পল্লী সংলগ্ন কেউটে গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। মূলত জন্মভূমির প্রতি ভালবাসার আকর্ষণেই তারা এই মন্দিরটি স্থাপন করেন। মন্দিরটির প্রবেশপথেই দক্ষিণ দিকে রয়েছে সিংহদুয়ার। দুপাশে রয়েছে উপবেশনের বেদি। পূর্ব পশ্চিম উত্তরেও প্রবেশপথ রয়েছে। বর্তমানে সেই প্রবেশপথ অবশ্য বন্ধ থাকে। মন্দিরটি আটচালা। গর্ভগৃহের বিগ্রহ কষ্টিপাথরে নির্মিত। মূর্তি মন্দিরের শ্বেত পাথরের উপর স্থাপিত। বেদিতে খোদিত
লিপিতে লেখা রয়েছে– শ্রীশ্রীকৃষ্ণ জিউর এই মন্দির‌ শক ১৭০৭ ইং ১৭৮৫ সালে কলিকাতা নিবাসী ধর্মপ্রাণ ৺নিমাই চরণ ও ৺গৌরচরণ মল্লিক মহাশয় কর্তৃক নির্মিত হয়। পরে ৺নিমাই চরণ মল্লিক ইং ১৮৩৭ সালে বিগ্রহের নিত্যপূজার স্থায়ী বন্দোবস্ত করেন। ন্যাসরক্ষক শ্রী কাশীনাথ মল্লিক, কলিকাতা। তাহাদের স্মৃতি রক্ষার্থে এই প্রস্তর ফলক স্থাপিত হইল। রাস পূর্ণিমা, ১৩৮২ সাল।

ছবিঃ রথতলার রথ ও কৃষ্ণরাইজির মন্দির

চিত্র গ্রাহকঃ মণি ভট্টাচার্য

মন্দির গাত্রে রয়েছে পোড়ামাটির কারুকার্য। মন্দিরের বিশাল চত্বরে রয়েছে ভোগ বা প্রসাদ গৃহ, রয়েছে বিশ্রামাগার। কৃষ্ণরাইজি বিগ্রহটি বরাভয় যুগল মূর্তি।
এই বিগ্রহে শ্রীকৃষ্ণের হাতে কোন বংশী নেই অর্থাৎ তিনি বংশীবদন রূপে এখানে প্রতিষ্ঠিত নয়। শ্বেত পাথরের বেদীতে বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠিত।

মন্দিরের উপরিভাগ গম্বুজাকৃতি। পাঁচটি গম্বুজ দ্বারা সৌন্দর্যায়ন কৃত। প্রথম দ্বিতীয় চতুর্থ পঞ্চম গম্বুজের শীর্ষে রয়েছে চারটি ধ্বজা এবং তৃতীয়টিতে রয়েছে একটি চক্র। পূর্ব দিকে রয়েছে দোল মঞ্চ। এখানে দোল উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়।এখানৈ রয়েছে তুলসী মঞ্চ।

এই মন্দিরটির অন্য এক ইতিহাস ও প্রাচীনত্ব রয়েছে। অন্যতম চৈতন্য পার্ষদ কবি শিবানন্দ সেন কাঞ্চনপল্লীতে থাকতেন। শ্রীচৈতন্যদেব তার গৃহেযআগমন করেছিলেন। এমনই বলা হয় যে শিবানন্দ সেন চৈতন্যদেবের মৃত্যুর পর তার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন এবং সেই অনুযায়ী ভাগীরথীর গর্ভে একটি কষ্টিপাথর প্রাপ্ত হন। সেই কষ্টিপাথর থেকে কৃষ্ণদেবের মূর্তি নির্মাণ করা হয় এবং তার সঙ্গে তিনি নির্মাণ করেন অষ্টধাতুর রাধিকা মূর্তি। এই যুগল বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণদেব রাই নামে পরিচিত। আরো জানা যায় শিবানন্দ সেন তার গুরু শ্রীনাথ পন্ডিতের নামে এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বৈষ্ণব ভক্তদের বিশ্বাস শ্রীচৈতন্যদেব শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে এই ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করেন।

বিগ্রহের প্দ্মাসনে একটি শ্লোক খোদিত আছে।
শ্লোকটি এমনস—
স্বস্তি শ্রীকৃষ্ণদেবায় প্রাদুরাসীৎ স্বয়ং কলৌ।
অনুগ্রহায় দ্বিজং কিঞ্চিৎ শ্রীলং শ্রীনাথ-সংজ্ঞকম্।।

‘বৈষ্ণবাচার দর্পণ’থেকে জানা যায়—
চিত্রাঙ্গী যে সখি এবে শ্রীনাথ পণ্ডিত।
গৌরাঙ্গের শাখা কুমারহট্টতে বিদিত।।
কৃষ্ণ রাই শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করিল।
সেবা করি সেন শিবানন্দে সমর্পিল।।
সেন শিবানন্দের পুত্র কবি কর্ণপুর তার ‘গৌরগণদ্দেশ দীপিকা’তেও কৃষ্ণরাইজীর মন্দির, শিবানন্দ সেন এবং শ্রীনাথ পন্ডিতের কথা উল্লেখ করেছেন।

আরো জানা যায় বর্তমান মন্দিরটি তৃতীয় পর্যায়ের মন্দির। সেন শিবানন্দের প্রতিষ্ঠিত আদি মন্দিরটি গঙ্গা ভাঙ্গনে গঙ্গা গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তীতে যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্যের খুল্লতাত পুত্র কচুরায় আরো একটি মন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে এই মন্দিরটিও গঙ্গা গর্ভে বা অন্য কোন কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তৃতীয় পর্যায়ে এই মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন নয়নচাঁদ মল্লিকের দুই পুত্র নিমাইচরণ ও গৌরচরণ মল্লিক।

এই জনপদ এক ইতিহাস জড়িত আঞ্চলিক ক্ষেত্র।