১৬ জুন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিবসঃ

কাঁচরাপাড়ায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সলিল চৌধুরী মধ্যিখানে সুকান্ত ভট্টাচার্য

তমাল সাহা

সুসংবাদ যত ছিল কাঁচরাপাড়ার বুকে আকাশের নিচে অনন্ত বীথির ভেতর, কত ছিল তার সুগন্ধ,সূবাস!

কাঁচরাপাড়ায় পাতাঝরা বেলায় হেমন্তের অরণ্যে রাণার হয়ে এসেছিলেন দুজন– হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সলিল চৌধুরী। তাদের হাতে ছিল নিশ্চিত সুকান্তের ঠিকানা। হেমন্ত ও সলিল সশরীরে নিজেরা এসেছিলেন কাঞ্চনপল্লীর এই জনপদে কিন্তু সশরীরে সুকান্তকে আনতে পারেনি। তবুও সুকান্ত জড়িয়ে গিয়েছে কাঁচরাপাড়ার জীবনে।

কাঁচরাপাড়ায় কোনোদিন সুকান্ত পাঠাগার গড়ে উঠেছিল ওয়ার্কশপ রোডে হরিসভা সংলগ্ন অঞ্চলে। সত্তর দশকে সুকান্তের নামে আরো একটি পাঠাগার গড়ে উঠেছিল রজনীবাবু রোডের ভেতরের দিকে একটি পাড়ার মধ্যে। সুকান্তর কিশোর বাহিনী গড়ে উঠেছিল মান্ধারী হাইস্কুল সংলগ্ন আর্য সমিতির মাঠে আশির দশকে।

সলিল চৌধুরী এসেছিলেন অনেক আগে। তখন IPTA- এর কাল। গণসঙ্গীতের টিম তৈরির কাজে হাত দিয়েছে IPTA। সলিল চৌধুরী ছিলেন IPTAর সদস্য। সদস্য ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও। সলিল চৌধুরী এখানে গণসঙ্গীতের ক্লাস নিতে আসতেন কাঁচরাপাড়া-হালিসহর অধ্যূষিত অঞ্চলে। কাঁপাতে গিয়ে শিবদাসপুরের মেঠো অঞ্চলে জেঠিয়ার গাছগাছালির লোকালয়ে কোনোদিন গণসঙ্গীত গেয়েছিলেন সলিল চৌধুরী।

যাক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে আসা যাক। জন্ম শতবর্ষে তাঁকে নিয়েই একটু বেশি লিখি। সলিল চৌধুরীর সুর, সুকান্তর কবিকন্ঠকে জন মাধ্যমে এনেছেন এই মানুষটি– হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
রাণার রাণার ভোর তো হয়েছে আকাশ হয়েছে লাল/ আলোর স্পর্শে কেটে যাবে কবে এই দুঃখের কাল।
দরাজ কন্ঠে সুকান্ত সঙ্গীত গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর কি গেয়েছেন হেমন্ত? সুকান্তর সেই কবিতা– অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরও/ দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারও।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সলিল চৌধুরীর সম্পর্ক, নৈকট্য কে না জানে? তেমন সুকান্তও ছিলেন সলিল চৌধুরীর অন্তরঙ্গ বন্ধু। পরবর্তীতে সুকান্তর কবিতা, সলিলের সুর আর হেমন্তর কন্ঠ একাকার হয়ে যায় বাংলার আকাশে বাতাসে।

সুকান্ত সলিলকে বলেছিলেন, কী বলেছিলেন? বলেছিলেম,ভাই! যদি সম্ভব হয় আমার কবিতাকে কোনোদিন গানে রূপান্তর করা যায় কিনা ভেবে দেখিস।
সলিল চৌধুরী কথা রেখেছিলেন। এমন ছোট্ট বন্ধুর কথা ফেলা যায়!
সুকান্তর মৃত্যুর আগেই রাণার কবিতার সুরারোপ করেছিলেন তিনি আর কবিকে শুনিয়েও ছিলেন। কবি সুকান্ত খুবই মুগ্ধ ও আপ্লুত হয়েছিলেন রাণার গানের সুরে। সেই কবিতাকে সলিলের সুরে আশ্চর্য গায়কীতে এনে ঝড় বইয়ে দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

কাঁচরাপাড়ার কালীপুজো তখন বিখ্যাত। কালীপুজো মানেই ফাংশন বা জলসা। সূর্য সমিতির পুজো হতো ওয়ার্কশপ রোডে, সতীশ নন্দী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিপরীতে। সেই পুজোয় সেইবার জলসা অনুষ্ঠিত হলো এখন নবনির্মিত পৌরসভায় উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। সেটা ষাটের দশকের মধ্যভাগ। সেখানে বিশেষ শিল্পী হয়ে গান গাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেখানে গাইলেন– আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা।
রাণার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে।
আর কি গাইলেন? সপ্তপদীর সেই গান– এই পথ যদি না শেষ হয়।

সাদা ধুতি শার্ট, কালো ফ্রেমের চশমা। আপাদমস্তক বাঙালি শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আফ্রিকা, রোম, কানাডা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করলেন পুরোদস্তুর বাঙালি।

এবার তিনি আবার এলেন সার্কাস ময়দানে। ভারতী সংঘের আয়োজনে দুদিনের অনুষ্ঠান। একদিন জলসা অন্যদিন নাটক — “লেনিন কোথায়”।
প্রথম দিনের শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেখানে তিনি গাইলেন সেই বিতর্কিত ছবি — নীল আকাশের নীচে, চিনে ফেরিওয়ালার গল্পের– ও নদী রে…
পরপর গান গাইলেন তিনি– আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা। সেসব হিট গান।
ইংরাজি “সিদ্ধার্থ” বইতেও গেয়েছেন এই বাংলা গানটি– ও নদী রে।
তাছাড়া তিনি গেয়েছিলেন সার্কাস ময়দানে মরুতীর্থ হিংলাজের সেই গান– পথের ক্লান্তি ভুলে।
বাংলা ছাড়া আবার গান হয় নাকি! তিনি গাইলেন– আমি দূর হতে তোমাকেই দেখেছি– কে কাকে দেখে? কে কাকে দেখেছিল?

আর ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম। তার গাওয়া সেই গান– মা গো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা ও হেমন্তের কন্ঠের এই পানে দেশপ্রেমে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো এপার ওপার বাংলা। তিনি গাইলেন– তুমি এলে অনেকদিনের পর যেন বৃষ্টি এলো। এই ভালোবাসা কেন্দ্রিক গানের মূল দ্যোতনায় এখন কত কন্ঠ শুনতে পাচ্ছি।

আর? কেন দূরে থাকো, কেন আড়াল রাখো– চোরাপ্রেমের নির্মল স্রোত এই গানটিও তিনি যখন সার্কাস ময়দানে গেয়ে ওঠেন তখন মূহুর্মূহু করতালিতে ভেসে যায় শ্রোতাদের আনন্দঘন হৃদয়ের উত্তাপ।

আয় খুকু আয়– পিতা পুত্রীর এমন আবেগ হেমন্ত আর শ্রাবন্তীর জুটি তো অবিনশ্বর হয়ে আছে আজও।

সপ্তপদীর সেই গান– হেমন্ত- সন্ধ্যার জুটি– এই পথ যদি না শেষ হয় সেই গানটি, যে গানটির কথায় মাত করে দিয়েছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর কন্ঠে মাতাল করে দিয়েছিলেন হেমন্ত।

হেমন্ত ও সলিলের উজ্জ্বল জুটি দুটি গান– ও নদী রে/ একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে আর আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা– আজও চিরস্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে।

মৃণাল সেন জড়িয়ে গেলেন সলিলের গানে। “চিনে ফেরিওয়ালা” লেখিকা মহাদেবী ভার্মা, কবি সাহিত্যিক স্বাধীনতা সংগ্রামী। তার বই, এই কাহিনি শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত হলো ‘নীল আকাশের নীচে’– এই চলচ্চিত্রে। এই চলচ্চিত্রের নায়ক হবার কথা ছিল উত্তম কুমারের সেখানে চান্স পেয়ে গেলেন কালি ব্যানার্জি। চিন ভারতের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ছবিটি নিষিদ্ধ হয়ে গেল মুক্তি পাবার দু বছর বাদে। পরে কংগ্রেস নেত্রী সুচেতা কৃপালিনীর সক্রিয়তা এবং প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নির্দেশে ছবিটি আবার মুক্তি পায়।

এতসব গানের কথা,সুর, কন্ঠ নিয়ে এত অভিঘাত লুকিয়ে আছে কাঁচরাপাড়ার বুকে। কত সহজ,সারল্যে একটা কাঠের চেয়ারে বসে, একটা কাঠের চেয়ারে হারমোনিয়ামটি রেখে হৃদয় উজাড় করে হৃদয় জুড়ানো গান গেয়ে গেছে তুমি! ভাবা যায়! পুরানো সব ছবির দৃশ্যপটতো সে কথাই বলে যায় আমার কানে কানে।
নৈহাটীতে কল্যাণী সিনেমা হলেও একদিন তোমার অনুষ্ঠান শুনেছি আমি আর মণি মানে মণি ভট্টাচার্য। সেই মণিও চলে গেছে এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে।

হেমন্ত যে গানটি গেয়েছিলেন কাঁচরাপাড়ার সার্কাস ময়দানে, সেই গানটি মৃত্যুর মাত্র দুবছর আগে বাংলাদেশ সফরে গেয়েছিলেন— আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে/ আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে।

তার গানের স্বরলিপি এখনও লেখা রয়েছে এপার ওপার বাংলার প্রেম, ভালোবাসায়, সংগ্রামে ও যুদ্ধে।

শোনো, হেমন্তের অরণ্যে পোস্টম্যান! তোমাকে মনে রেখেছে কাঁচরাপাড়া।

ছবি সংগ্রাহকঃ মণি ভট্টাচার্য
নৈহাটি কল্যাণী সিনেমা হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।i