অবতক খবর : স্বাধীনতার পূর্বের সময়কাল থেকে আজ পর্যন্ত, হ্যাঁ পারে। বাঙালিই শিখিয়েছে বারে বারে ঘুরে দাঁড়াতে। মনে আছে? যারা ব্রিটিশের দূর্গ চূর্ণ করে রাতের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিলো,শত শত বিপ্লবীদের হত্যার পরেও স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলো বিদেশীদের মুখ থেকে। আবার কখনো আরেক বাঙালি যিনি দেশকে শিখিয়েছিলেন জাতীয় সংগীত, তিনি আমাদের কবিগুরু কলম উঁচিয়ে, বুক চিতিয়ে একসময় নোবেল জিতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্ত বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় মহাশয় গর্বের সাথে দেশ কে উপহার দিয়েছিলেন বন্দেমাতরম যার, প্রতিটা বাণীর পরতে পরতে ছিল আবেগের গন্ধ। রসগোল্লা প্রিয় মিষ্টি স্বভাবের শান্ত জাতি রেগে গিয়ে কিন্তু অনেক সময়ই অসম্ভব কে সম্বভ করে তুলেছে তার সাক্ষী রয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। ব্রিটিশদের সাথে সিরাজদৌলার একার লড়াই আজও কেউ ভোলেনি। মনে আছে? আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে পৃথিবীর একদিক থেকে আরেকদিকে দাপিয়ে বেরিয়ে ছিলেন আরেক জন। একশো সাতাশ বছর আগে শিকাগোতে এক সন্ন্যাসীর বক্তৃতার আস্ফালন রক্তহিম করে দিয়েছিলো অনেকের মনে পরেতো সে কথা? আবার কখনো লর্ডসের গ্যালারিতে কোনো এক বাঙালির জার্সি ওড়ানো মনে করায় ক্রিকেট ইতিহাসের আরেক অধ্যায়কে। আসুক না,এবারেও পারবো আম্ফানের দাপট সয়ে নিতে। কেরল,মুম্বাই, ভিয়েতনামের, ইন্দোনেশিয়ার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও সবার জন্য গলা ফাটিয়েছিল স্বদেশ ও প্রবাসের বাঙালি সমাজ। নিজের রাজ্যের এহেন অবস্থাতে তারা সাহায্যের দু হাত না বাড়িয়ে কি থাকতে পারে ? দেশ বিদেশের সবাই আজ একসাথে নেমেছে ময়দানে। এই ছবিটাই তো বারে বারে দেখিয়ে দেয়,ভারতবর্ষের সনাতন ঐকের মুহূর্তেকে। আজ বাংলায় বসবাসকারী ব্যাবসায়ী পাঞ্জাবী, গুজরাটি থেকে মাড়োয়ারি সমিতি গুলো নেমেছে অর্থ সংগ্রহে, সেতো বাংলাকে ভালোবেসেই। সত্তরউর্দ্ধ প্রধানমন্ত্রী ছুটে এসেছেন বাংলার পাশে থাকার কল্যানে। মুখ্যমন্ত্রী একা হাতে সামলাচ্ছেন সবদিক, কখনো করোনার আবহে কখনোবা আম্ফানের দাপটে বিধ্বস্ত বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে গেছেন বারে বারে। বাংলা বলতে পারেন না, তবুও রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর এই বিপদের দিনে রাজনৈতিক বাক্যবিনিময় ছেড়ে, ব্যাক্তিগত ভাবে পঞ্চাশলক্ষ্ টাকা দান করেছেন মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। সেটাও তো বাংলা কে ভালোবেসেই। দেশের তিন প্রধান একসাথে ছুটেছেন দুর্গত মানুষ গুলোর পরিস্থিতি সচক্ষে দেখতে, এতো সেই ঐক্যেরই প্রতীক, বাংলার ডাকে তাই আজ সবাই মিলেমিশে এক হয়ে গেছে ।

আম্ফান চলেযাবার পর একশো ঘন্টারও বেশি সময় কেটে গিয়েছে,কেড়ে নিয়ে গেছে অনেকের শেষ আশ্রয়টুকুও, শুধু রেখে গেছে তার চিহ্নটা। সব কিছু হারিয়ে সর্বহারা মানুষগুলো এখন নিঃস্ব,সহায় সম্বলহীন হয়ে পেটে ভাত না পেয়ে,মাথার ছাদ হারিয়ে,চিড়ে,মুড়ি,গুর বাতাসা খেয়ে এককাপড়ে আশ্রয় পেয়েছে পাড়ার কোনো ক্লাবে বা স্কুলে। একের পর এক টিভি তে আর সোশ্যালমিডিয়ার দৃশ্যগুলো বিষন্ন করেছে আপামোর ভারতবাসীর মনকে। এসব দেখে কেউ বলছে “উফ! কি ভয়ঙ্কর,” আবার কখনো পরিস্থিতির কথা জানতে চেয়ে ভিনরাজ্য থেকে কোনো অবাঙালি বন্ধুর ফোন এসেছে আরএক বাঙালি বন্ধুর কাছে। সত্যিই তো,উদাসীনতার কোনো প্রশ্নই উঠে না আজ। দুর্গতরা তাদের পাশে পেয়েছে ভারত সেবাশ্রম সংঘ,রামকৃষ্ণ মিশন, ইসকনকে। সেনাবাহিনীর জওয়ানরাও এসে গেছে সাহায্য করতে।
দেশ বিদেশের বঙ্গ শিল্পী সাহিত্যিক বুঝিজীবিদের আজ আসতেই হবে তাদের বাংলাকে বাঁচাতে। সন্দেশখালি,কাকদ্বীপ, গোসাবা,হাসনাবাদ, টাকি, নদীর বাঁধভাঙা জলেরতলায় থৈ থৈ করছে, আর আমাদের সাধের পুরোনো শহর কলকাতা ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়ে রয়েছে। সবুজে সাজানো শহরটা নিমেষেই কোনো অজানা এক মরুভুমির চেহারা নিয়েছে। 1737 এর ভয়ঙ্কর এক ঘূর্ণির দাপাদাপির পরেও আইলা, বুলবুল,ফনিকে সামলে ছিল কলকাতা। দুঃখের বিষয়টা এবারটা বোধহয় আর পেরে উঠতে পারলো না,কেবল বোটানিক্যাল গার্ডেনের আড়াইশো বছরের ঐতিহ্যবাহী বটগাছটা তার মাটি আঁকড়ে জিতে গেল এবারেও। আম্ফানের পর চারিদিকের জলছবিটা মনে করায় এ শুধু বৃষ্টির জলই নয় এ যেন প্রিয়তমা শহরের কান্নার চোখের জল আর সেই জলের স্রোতেই এক এক করে ভেসে যাচ্ছে বইপাড়ার বইগুলো।

ছিয়াত্তরের মরণোত্তর ই হোক বা জাতিদাঙ্গা,দেশ ভাগ, মহামারীর কত কিছুর পরেও বাংলা হারেনি,একাই পেরেছিল সবকিছু সামলাতে। দৃঢ়তার সাথে এবারও সে পারবে আবার উঠে দাঁড়াতে। রাজনৈতিক দলাদলি ছেড়ে হাতে হাত রেখে ডান -বাম,দাদা-দিদি সবাই একসাথে লড়াই করুন বাংলা মায়ের জন্য, দুর্দিনে পাশে থেকে বাংলাকে বাঁচানোর জন্য। বিশ্বাস আছে, কাঠি করা বা কাঁকড়ার মতো টেনে না ধরে অনেক বড় কিছু করে দেখাতে পারে বঙ্গবাসী, তাদের সাধের বঙ্গের জন্য। মোমবাতি হাতে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শপথ বাক্যের সাথে থাকবে ফিরে আশার আহ্বান “আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়। ” আর সাথে থাকলো করজোরে বিনীত নিবেদন সে দিল্লিই হোক বা মুম্বাই, আমেদাবাদ থেকে হায়দ্রাবাদ হয়ে ব্যাঙ্গালোর কিংবা নিউইয়র্ক,লন্ডন,প্যারিস বা সিডনি কখনো টোকিও দিক বিদিক শহর থেকে যেন প্রত্যেক বঙ্গবাসী তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় বাংলাকে। সত্যিই তো এহেন কঠিন সময়ে স্বদেশী- প্রবাসী সবার সাহায্যেই তো নতুনভাবে গড়ে উঠবে আরেক বাংলা। আগামী খুশির ঈদ বা দুর্গাপুজোর আনন্দ আরেকবার অন্যরূপে ফিরে আসবে জীবনানন্দের বাংলার বুকে, নতুন করে আবার হাসি ফুটবে আজকের দুর্গত সর্বহারাদের মুখে।
——–সুমনা আদক সাঁতরা — —–