কল্যাণী বইমেলার অভিনব উদ্যোগ– পঁচিশে পঁচিশ।
সপ্তম দিনের বইমেলায় সংবর্ধিত হলেন দেহ-চক্ষুদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ চেতনা ঋদ্ধ মানুষেরা।
বইমেলা উপসমিতি লিটিল ম্যাগাজিন-এবার বইমেলার সঙ্গে সামাজিক পরিষেবার বিশেষ দায় যুক্ত করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল বইমেলা রজত জয়ন্তী বর্ষ অর্থাৎ ২৫-তম বর্ষকে স্মরণীয় করে তুলবার উদ্যোগ। এই উপসমিতির সম্পাদক দেবাশিস রায় জানান, তাদের লক্ষ্য ছিল দেহ ও চক্ষুদানে ইচ্ছুক ২৫ জন ব্যক্তি মানুষের কাছ থেকে আবেদন পত্র সংগ্রহ করা। কিন্তু সে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৯৩ জন হয়ে গেছে।

বইমেলা শুধু বই ছাড়াও কি করতে পারে তা দেখালো কল্যাণী বইমেলা।

এইসব মুখ
তমাল সাহা

শীতের প্রহরে
গাঙ্গেয় উপকূলে বইমেলার প্রান্তরে দেখা যায়
কিছু শ্রমিষ্ঠ সরলবর্গীয় বৃক্ষসমান মানুষ।
এরা কারা, এইসব কাদের মুখ?
চারিদিকে ঘিরে আছে বইয়ের স্টলগুলি কিন্তু বই ছাড়া আর কি চাই?
আমি পরপর দেখি গণ দর্পণের শ্যামল চ্যাটার্জি, নির্মল হৃদয়ের মোসলেম মুন্সি, দৃষ্টিহীন রতন দে-লক্ষ্মণ বেসরার মুখ!

অন্ধকারের ভেতর নক্ষত্রগুলি এক এক করে জ্বলে উঠতে থাকে
এখনো মানুষ আছে, এখনো মানুষ আছে বলে
শীতের বাতাস আছড়ে পড়ে মাঠে।

হেমন্তের শেষ বেলায় দুদিন আগে জাওয়াদ ঝড়ের কারণে বৃষ্টি হয়ে গেছে
মাঠে ছিল গোড়ালি ডুবে যাওয়া জল
সেই মাঠে আজ পরিপূর্ণ কোলাহল।

মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়
তারা চায় একটি সংযোগ সেতু–প্ল্যাটফর্ম।
সেই প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পেলে
কত মানুষ এসে পড়ে কাতারে কাতারে।
এইসব দেখে
শ্যামল-মোসলেম-রতন-লক্ষ্মণের মুখ যেন সার্চ লাইটের আলোতে উজ্জ্বল!
দেহ-চক্ষুদানের জন্য মানুষের এতো আগ্রহ!
টেবিল উঁচু হয়ে ওঠে আবেদন পত্রের স্তূপে
হোয়াটসঅ্যাপে হাতের অক্ষরে– আমিও আছি! আমিও আছি! বলে ওঠে কারা?

মানুষ আছে! মানুষ আছে্!
সে কথা শুধু ভাসতে থাকে হাওয়ায় হাওয়ায়।
এইসব মানুষ এই পৃথিবীতে থাকে নাকি,
তবে এতোদিন ছিল কোথায়!

শ্যামল বাবুর মুখে শুনি
কি করে দেহ জোগাড় হবে
কি করে চক্ষু জোগাড় হবে
দোরে দোরে গিয়ে সেই শ্রম ও সংগ্রামের কাহিনী।

মোসলেম মুন্সির যেন সর্বদা যুদ্ধের তৎপরতা।
মানসিক প্রতিবন্ধী সুস্থ হয়ে কি করে ফিরে যাবে
বাড়ি,সেই শুভবার্তা।
মোসলেম বাবু বলে, সেই মানসিক পাগলের কথা, যোগিন্দর খেতরা তার নাম—
জামার ওপরে জামা বাইশটি জামা
প্যান্টের ওপর প্যান্ট সাতটি প্যান্ট—
এতো পরিচ্ছদ পরে রাস্তায় ঘোরে
মাথাভর্তি ধুলোমাখা ঝাঁকড়া চুল
সেই চুলে বসত করে উকুনের দল।
মোসলেম বাবু বলে, কিভাবে তার পরিষেবা করে।
আর বলে মানুষের বিচিত্র চরিত্রের কথা—
সন্তান দুর্ঘটনায় মৃত শুনে অর্থ আদায়ের চাতুরি
শোক ও স্নেহের চেয়ে মুদ্রা ওজনে ভারি!

রতন-লক্ষ্মণবাবুর অন্ধ চোখে আলো ফোটে–
তারা বলে, আরো দৃষ্টিহীনের নিতে পারে দায়
বইমেলা থেকে যদি তারা নিয়মিত সাহায্য পায়।

ওদিকে বইমেলার মাঠ ছাপিয়ে যাওয়া
বিশাল আকাশের চাঁদ বড় হতে থাকে
স্টলের বইগুলি নড়েচড়ে ওঠে।

এখনো কারো জন্য কিছু করে উঠতে পারিনি—
এই অকর্মণ্যতার আত্মগ্লানিতে
নিষ্কর্মা এই অক্ষরজীবী শুধু চেয়ে চেয়ে
দৃশ্যগুলি দেখে…