অবতক খবর,তমাল সাহা, ২৭ সেপ্টেম্বরঃ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত সেমিনারঃ সংবাদে, সিনেমায় দেশভাগ। বক্তব্য রাখলেন চলচ্চিত্রকার তানভির মোকাম্মেল।

ওপারে মানে পদ্মা পারে থাকেন তিনি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্মান একুশে পদক পেয়েছেন। কতবার যেন চলচ্চিত্রের বিভিন্ন বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন– বার দশেক হবে বোধ করি। অস্কারের জন্য নমিনেটেড হয়েছেন বা বিএফআই বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর— তবে এসব বড় কথা নয়, মানুষটা বুঝিয়ে দিতে পারেন রাষ্ট্র কি আর দেশ কাকে বলে। মানুষটা বলেন, রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক হতে পারে, দেশ তো গাছপালা জলবায়ু নদী-নালা মানুষ। এর আবার সম্প্রদায় হয় কি করে। তিনি স্পষ্ট বলেন, ৪৭-এর দেশভাগের যন্ত্রণার সিনেমা বাংলাদেশে তেমন হয়নি।

দাঙ্গার কারণে হয়তো বাংলাদেশের মানুষের একটা পাপ বা অপরাধবোধ আছে। হিন্দুরা দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে গেছে তাতে কারুর বৈষয়িক লাভ হলেও বাংলাদেশের মানুষের ক্ষতি হয়েছে। দেশভাগের উচ্চবিত্ত শিক্ষিত মানুষরা চলে যেতে পারে কিন্তু নিম্ন-পিছিয়েপড়া মানুষরা বাস্তু জমি ছেড়ে যেতে ভয় পায়। অন্য জায়গায় গেলে তারা খাবে কি? তার নিশ্চিত হদিশ আছে নাকি? শিক্ষিত মানুষ চলে গেলে কি দেশের ক্ষতি হয় না? হিন্দুরা তো শিক্ষিতই ছিল। এত কত শিক্ষিতজন চলে গেছে, দেশের ক্ষতি হয়নি?

নিমাই ঘোষ ঋত্বিক ঘটকরা যেভাবে দেশভাগ উদ্বাস্তুর যন্ত্রণা বেদনা তুলে ধরেছেন তেমন আর কজন পেরেছেন? আমরা শিল্পীরা ধর্ম দেখিনা, মানুষ দেখি। এখন ৪৭-এর দেশভাগের সেই ছবি নির্মাণ সম্ভব নয়। সেই পুরাতনী পরিবেশ নেই। এর জন্য রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বিষয়টিও এখন ভাবতে হয় আর প্রয়োজন সাহস। তিনি বলেন, যুদ্ধ আর দেশভাগে নারীদের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। তাদের ধর্ষিতা হতে হয়। তাদের আশ্রয় নড়ে যায় নিজের বাস্তুভূমি থেকে। আরেকবার ঠাঁই গড়তে হয় ট্রেন লাইনের ধারে বস্তিতে।

এ সবই তানভির মোকাম্মেলের কথা। তার সঙ্গে যখন আড্ডা হচ্ছিল এসব কথাই হচ্ছিল।

তার ছবি জল ও জীবনের ছবি। তার ছবি দেশের ছবি, মানুষের ছবি। দেশভাগের বেদনার ছবি।

সীমান্ত রেখা কি? তিনি বলেন, এটি কি দুটি রাষ্ট্রের মাঝে কাঁটাতার, এটি কি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভাজনের ধর্মীয় কাঁটাতার, না এটা মানবিক চেতনাহীনতার বা চেতনা অবনমনের কাঁটাতার?

‘সীমান্ত রেখা’ দেশ বিভাগের বেদনার প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। এ ছবি ঠাইনড়া মানুষের ছবি– কুপার্স ক্যাম্পের মানুষের ছবি, পিএল ক্যাম্পের মানুষের ছবি, এক মুঠো চাল-ডাল- গমের ছবি।

‘চিত্রা নদীর পারে’ বহতা জীবন নদীর ভাঙাগড়ার ছবি।

আমি বলি, নদী তো আপনাকে গ্রাস করেছে। চিত্রা নদীর পারে, নদীর নাম মধুমতী, কর্ণফুলীর কান্না, রূপসা নদীর বাঁকে, ওয়ি যমুনা আপনার চলচ্চিত্রে উঠে আসে।

মোকাম্মেল সাহেব বলেন, আরে নদীর মতোই তো জীবন, জীবনের মতোই তো নদী!

তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন নির্মলেন্দু গুণের বিখ্যাত কবিতা হুলিয়া নিয়ে। স্মৃতি একাত্তরে তিনি দেখান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকান্ড, লালন-কে তুলে আনেন, নিম্নবর্গের ঢাকির জীবনচিত্র আঁকেন জীবন ঢুলিতে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিখ্যাত উপন্যাস লালসালুর চলচ্চিত্রকার তিনি।

রাজনীতি সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার চলচ্চিত্রে সবই রাজনীতি। মানুষের জীবনের দ্বন্দ্ব সংঘাত তুলে ধরাই রাজনীতি। সত্যকে তুলে ধরাই আমার রাজনীতি।

কবি ও সাংবাদিক তমাল সাহার সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকারে

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাসাগর সভাগৃহে ‘সংবাদে সিনেমায় দেশভাগ’ শীর্ষক আলোচনা ২৭ সেপ্টেম্বর’২২ একক বক্তৃতায় ছিলেন তানভীর মোকাম্মেল।

তার সঙ্গে এসব নিয়েই একপ্রস্ত কথাবার্তা হলো।

অনুষ্ঠান উদ্বোধক কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মানস কুমার সান্যাল স্বাগত ভাষণে জানান, তানভির মোকাম্মেলের মতো একজন মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গর্বিত। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় যোগাযোগ করছে যাতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা আরো ব্যাপকতর করার জন্য বিদগ্ধজনকে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় স্বাগত জানানো যায়।

কোঅর্ডিনেটর অধ্যাপক ডক্টর সুখেন বিশ্বাস ও অধ্যাপক ডক্টর সঞ্জিত মণ্ডল

বলেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তানভির মোকাম্মেলের শিল্প সৃষ্টি এবং শিল্পী মননের মুখোমুখি হতে পেরে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই উপস্থিত সুধীমন্ডলী নিশ্চিত ভাবে সমৃদ্ধ হবেন।