আজ কথাশিল্পী পথের পাঁচালী স্রষ্টা ভূমিপুত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন

বিভূতিভূষণ, কাঁচরাপাড়া এবং রেল কারখানা

তমাল সাহা

তিন বাঁড়ুজ্জ্যে কাঁচরাপাড়ায় এসেছিলেন কোনোদিন। বাঁড়ুজ্জ্যে মানে বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনজনই সাহিত্যের দিকপাল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

পথের পাঁচালী, গণদেবতা ও পদ্মানদীর মাঝি— এই তিনটি কালজয়ী উপন্যাসের কথা উঠলেই বাংলার যে কোনো পাঠক নিশ্চিত বলে দিতে পারেন– আরে! এ যে তিন বাড়ুজ্জ্যের লেখা।

এই তিনটি ঐতিহাসিক জীবন কথাশিল্পের চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছে। এই উপন্যাস ত্রয়ীর সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণের নির্দেশক ছিলেন সত্যজিত রায়, তরুণ মজুমদার এবং গৌতম ঘোষ।

আমরা চলে যাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়। বিভূতিভূষণ এবছর একশো পঁচিশ বছরে পা দিলেন। দিনটি ১২ সেপ্টেম্বর।

একদা কাঁচরাপাড়া বোর্ডের মুরাতিপুর গ্রামে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মেছিলেন। এখন তা কল্যাণীর অন্তর্গত। তাঁর জন্মস্থান চিহ্নিত করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করেছে।

তিনি ‘খুঁটির দেবতা’ গল্পে রাঘবকে নায়ক করে কাঁচরাপাড়া কারখানা ও তার সাইরেন ধ্বনির কথা উল্লেখ করে গেছেন।

১৯২৯-৩০ সাল। তিনি একবার ফিরেছিলেন নিজের গাঁয়ে। শৈশবের হিরন্ময় রোদ আর তৃণাঙ্কুরের গায়ে শিশির দানা খুঁজতে।বাস রিজার্ভ করে তাঁরা এসেছিলেন। তাঁরা মানে বিভূতিভূষণ ও সজনীকান্ত দাস।

কাঁচরাপাড়া থেকে বড় জাগুলিয়া হয়ে মরিচা গ্রামে গিয়েছিলেন তাঁরা ওষুধপত্র সংগ্রহ করতে। তারপর আবার কাঁচরাপাড়া।

কাঁচরাপাড়ার মাঠের উপর দিয়ে ছুটে চলল বাস। তাঁরা চলে এলেন হালিসহরের ডাকসাইটে কবি- সমালোচক আরেক প্রখ্যাত মানুষের কাছে। তিনি কে? মোহিতলাল মজুমদার।তাঁর বাড়িতে। এই মোহিতলাল রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত ছেড়ে কথা বলেননি। তাঁরও সমালোচনা করে গিয়েছেন। তাঁরা গিয়ে শুনলেন মোহিতলাল সাহাগঞ্জে কোনো কাজে গিয়েছেন।

তাঁরা কাঁচরাপাড়া বাজারে জলপানি সেরে হালিসহর খেয়াঘাটে এসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। পরে মোহিতলালের সঙ্গে দেখা হলো।

দুপুরে মোহিতলালের বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার পর সাহিত্য সম্পর্কিত আলোচনাও হয়েছিল। তারপর তাঁরা বেরিয়ে পড়লেন কেওটা- হালিসহরের দিকে ছোটবেলার সেই প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের পাঠশালার খোঁজে। পোড়ো ভিটে জঙ্গলে ঢেকে ফেলেছে। খুঁজে পেলেন সেই জামরুল গাছ।

হায় স্মৃতি! দেখা হলো রাখাল চক্রবর্তীর স্ত্রীর সাথে। তিরিশ বছর পর তাঁর সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা বিপিন মাস্টারের পাঠশালায় একসাথে পড়েছে। তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল কেওটা হালিসহরের হারিয়ে যাওয়া সেইসব স্মৃতির হিরে জহরত। শীতলের মায়ের কথা, আতুরীর কাছে ধামা কুলো বেচার কাহিনি। রাত আটটা বেজে গেলো শুধু কথাবার্তায়। দুর্ধর্ষ সমালোচক মোহিতলাল ‘পথের পাঁচালী’ বিষয়ে কত কথাই না বলেছিলেন বিভূতিভূষণকে।

কেওটা হালিসহরের সেই অশ্বত্থ গাছ শুনেছিল তাঁদের কথাবার্তা। কী কথাবার্তা? মোহিতলাল, সজনীকান্ত আর বিভূতিভূষণের ভবিষ্যৎ সাহিত্য মন্ডলী গঠনের কথা বার্তা।

আর কাঁচরাপাড়ার থুড়ি বর্তমানে কল্যাণীর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যদি পথের পাঁচালী না লিখতো তবে কি সত্যজিত রায় সত্যি সত্যজিত রায় হতে পারতো?।

আজ সত্যজিত রায়ের যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি তাঁর যে আন্তর্জাতিক অস্কার পুরস্কার প্রাপ্তি সে তো আসলে ‘পথের পাঁচালী’র জন্যই। পথের পাঁচালীর মাধ্যমেই তো বিশ্ব সত্যজিত রায়কে জেনেছিল। আর এই পথের পাঁচালী লিখেছিলেন আমাদের কাঁচরাপাড়ারই ভূমিপুত্র, অবশ্য অহঙ্কার একটু কমে গেছে আমাদের। কারণ কল্যাণী এখন তাঁর দখলদারি নিয়ে ফেলেছে।

আর সত্যজিৎ রায়! সেও কাঁচরাপাড়াকে ছাড়তে পারেনি। কাঁচরাপাড়া রেল কারখানার কাজ করতেন শীতলাকান্ত রায় (পটলবাবু)।সেই কর্মী যদি না থাকতেন তবে কি সত্যজিৎ রায় সেই বিখ্যাত ছোট গল্প ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ লিখতে পারতেন?

‘আঃ’ শব্দটি উচ্চারণের এমন শৈলী-বিভঙ্গ কি আমরা জানতাম! শুধুমাত্র ‘ আঃ’ শব্দটির সংলাপ-সম্বল নিয়ে অভিনয় জগতে এসেছিলেন কাঁচরাপাড়া কারখানার পটলবাবু।আর তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সত্যজিৎ রায়ের নাম।

উল্লেখ্য বিভূতিভূষণের ১২৫ তম জন্মোৎসব সাড়ম্বরে পালন করেছে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়। দুদিন ব্যাপী অনুষ্ঠান চলেছে ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর,২০১৯। ১২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠানে এসেছিলেন মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়-বিভূতিভূষণ পুত্রবধূ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, অমর মিত্র। ১৩ সেপ্টেম্বর এসেছিলেন বুদ্ধদেব গুহ, রুশতি সেন, হামিদ কাইসার– কথাশিল্পী বাংলাদেশ।