অবতক খবর,১২ জানুয়ারিঃ পৌষ সংক্রান্তির প্রাক মুহূর্তে শীতের প্রহরে চাঁদটি কুয়াশায় ঢেকে গেলে নক্ষত্রগুলি যখন নিষ্প্রভ আলো দেয় তার কিছুটা ঠিকরে পড়ে এই জনপদের অলিতে গলিতে। অদ্ভুত এই সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন দুজন মানুষ– নরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং সুভাষ চন্দ্র বসু। এই পরিবেশে হঠাৎ তাদের কথা মনে পড়ে যায়।

এই শহরে দেশপ্রেম পালিত হয়। এই শীতের প্রহরেও মানুষ তাদের কথা মনে রাখে। সজোরে জয় হিন্দ ধ্বনি ওঠে। ওঠে বন্দেমাতরম -এর গর্জন। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে পাড়ার নেতা। কোনো শিক্ষক, পাড়ার সুধীজন অথবা বয়সের ভারে ন্যুব্জ কোনো ব্যক্তিত্ব বা মেহনতের জীবনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কোনোদিন পতাকা উত্তোলন করতে দেখি নি এ শহরে। আর সে কী স্যালুটের প্রতিধ্বনি — নেতাজি অমর রহে। গান্ধীজি অমর রহে। বিবেকানন্দ অমর রহে। বীর সন্ন্যাসী অমর রহে। তবে সেভাবে ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, বাঘা যতীন, বিনয় বাদল দীনেশের নাম উচ্চারিত হতে দেখিনা এইসব দিনগুলিতে। কিছুতেই মনে আসেনা মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তদের নামের স্লোগান। কেন এটা ধারাবাহিক ভাবে প্রচলিত রয়েছে এই চরম আধুনিক ডিজিটাল যুগেও এই প্রৌঢ় বেলায়ও বুঝতে পারি না। যা হোক কাঁচরাপাড়ার ইতিহাস দেশপ্রেমের ইতিহাস।

এসব মনে করিয়ে দেবার কেউ নেই। নেই কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। গান্ধীজির নামের ধ্বনি ওঠেনা এই শহরে গান্ধীজির জন্মদিন বা মৃত্যুদিনে। গান্ধীজিকে শ্রদ্ধা জানাতে তেমন সোচ্চার স্লোগান ওঠে না যদিও কাঁচরাপাড়ায় গান্ধীজি এসেছিলেন একদিন। সে দিবসটাও স্মরণযোগ্য মনে করে না শহরের কেউ। সাম্প্রদায়িকতার সাক্ষী কাঁচরাপাড়ায় গান্ধীজি দাঙ্গা থামাতে স্বাধীনতাকালের পাঁচ দিনের মাথায় ১৯ আগস্ট কাঁচরাপাড়ায় এসে উপস্থিত হলেন।

হালিসহরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে সম্বর্ধনা দেওয়া হলো মান্দালয় জেল থেকে ছাড়া পাবার পর ১৯২৭ সালে ক্রেগপার্কে। কেউ বা কোনো সংস্থার স্মরণযোগ্য নয় সেদিন! নেতাজি সেদিন ভাষণও দেন।

কাঁচরাপাড়ায় নিরঞ্জন সেনগুপ্ত কলোনি রয়েছে। সেই প্রখ্যাত বিপ্লবীর জন্মদিন ২৬ জুলাই,১৯০৪ এবং মৃত্যুদিন ৪ সেপ্টেম্বর,১৯৬৯ মলিন হয়ে গেছে কাঁচরাপাড়ায়। কোনোদিন পালিত হয় নি।

মহান বিপ্লবের কারিগর বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির জন্মদিবস ৫ নভেম্বর,১৮৮৭ এবং মৃত্যুদিন ১৪ জানুয়ারি,১৯৫৪ আমরা বিস্মৃত হয়ে গেছি। এই নাগরিক জীবনে তার গুরুত্বই নেই। তার কোনো ছবিই নেই কাঁচরাপাড়া পৌরসভায়।

বিদ্রোহী কবি নজরুল জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন আমাদের। তিনি কাঁচরাপাড়ায় এসেছিলেন ১৯৪০ সালে রেলওয়ে ওয়েলফেয়ার উইকে সাংস্কৃতিক বিচারক হিসবে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সে দিবসটিও পালিত হয় না। এই যে একজন কবি, একজন রাজনৈতিক সত্তা বিশিষ্ট মানুষ, তার জন্মদিনটি কি শুভ জন্মদিন নয়? তার এখানে আগমনটি কি স্মরণীয় আগমন নয়? এসব প্রশ্ন মনে জাগে।

বিবেকানন্দ জন্মদিবস পালিত হয় জাতীয় যুব দিবস হিসেবে। পৌরসভা অতিবিলম্ব হলেও একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি স্থাপন করেছে কাঁপা মোড়ে। কিন্তু কেন তিনি কাঁচরাপাড়ায় ১৯০২ সালের মে মাসে এসেছিলেন? কেন ঐ অঞ্চলে তার মূর্তিটি স্থাপিত হল তার জন্য একটি ফলক উন্মোচন করার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও সেই ফলকটি আজও স্থাপন করা হলো না।এই হচ্ছে আমাদের দেশপ্রেম!

এখানে স্থাপিত হয়েছে সিপাহী বিদ্রোহের সেই নায়ক মঙ্গল পান্ডের প্রতিকৃতি। কিন্তু তার জন্মদিন, মৃত্যুদিন কি এখানে পালিত হয়? তাকে কি নাসামান্য পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়? তার জন্মদিন ২৯ জুলাই১৮২৭, তার মৃত্যুদিন ৮ এপ্রিল,১৮৫৭ এবং তার কৃতকর্মের সামান্য কিছু পরিচয় দিয়ে আজও কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয় নি। প্রজন্ম কিভাবে জানবে এই শহরের ঐতিহ্য?

যুগ সন্ধিক্ষণের কবি, বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রের জনক বলে যার পরিচিতি সেই ঈশ্বর গুপ্তকে সম্মান দেওয়া হয়েছে ছোট্টো একটি মূর্তি তৈরি করে ঈশ্বর গুপ্ত উদ্যানে। কিন্তু তার জন্ম ৬ মার্চ,১৮১২ তার সামান্য পরিচিতি, তার মৃত্যু ২৩ জুন,১৮৫৯ সেসব কোনো কিছুই লেখা নেই সেখানে। কোন উত্তরাধিকার দিয়ে যাচ্ছি আমরা প্রজন্মকে?

মৃত্যুঞ্জয়ী ক্ষুদিরাম বসুর একটি মূর্তি স্থাপিত রয়েছে ক্ষুদিরাম বসু অর্থাৎ স্পল্ডিং ইনস্টিটিউটে, রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত রয়েছে শ্রীলক্ষ্মী সিনেমার বিপরীতে, আরেকটি রয়েছে লিটল স্টার ক্লাবের সামনে, নেতাজীর আবক্ষ মূর্তি রয়েছে পৌরভবনের সামনে মুক্তাঙ্গনে।

জাতীয় বীরাঙ্গনা নারী রাণী রাসমণির দুখানি মূর্তি রয়েছে হালিসহরে। হালিসহর পৌরসভায় রয়েছে তার উপবিষ্ট অবস্থায় একটি মূর্তি। বাগমোড়ে রয়েছে তার পূর্ণাবয়ব মূর্তি। তার জন্ম ১৭৯৩, মৃত্যু ১৬ ফেব্রুয়ারি,১৮৬১।গান্ধী মোড়ে রয়েছে গান্ধীজির বেঁটেখাটো মূর্তি।জন্ম ২ অক্টোবর,১৮৬৯‌ মৃত্যু ৩০ জানুয়ারি,১৯৪৮। রাণী রাসমণির মূর্তি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িতদের নাম সুন্দর করে জাহির করা আছে পাদদেশের বেদিতে।

আর এই দুই মূর্তি অর্থাৎ রাণী রাসমণি ও গান্ধী মূর্তির পাদদেশ অঞ্চল বিজ্ঞাপন প্রচারের অঞ্চল অর্থাৎ বিজ্ঞাপন ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে বিভিন্ন নাগরিক সংস্থা, এমন কি পৌর প্রশাসন পর্যন্ত বিজ্ঞাপন দিয়ে সেই চত্বরটিকে রীতিমতো দৃশ্যদূষণ সৃষ্টি করে চলেছে। এটা কোন বঙ্গ-সংস্কৃতি ও রুচির পরিচয় দিচ্ছে কাঁচরাপাড়া?

এই আমাদের শহর। আমাদের দেশপ্রেম। জয় হিন্দ ও বন্দেমাতরমের বিশাল আয়োজনের শহর।