রাষ্ট্রীয় কৌশলে(!) একটি অপরাজিত মানুষের চলচ্চিত্র চিন্তন সংগ্ৰাম ও চলচ্চিত্র নির্মাণের পদ্ধতি প্রদর্শন করা গেল না তাঁর জন্মশতবর্ষকালে তাঁরই নামাঙ্কিত নন্দন হলে। জানিনা নতুন প্রজন্ম বঞ্চিত হল কি??

অপরাজিতঃ নির্দেশক অনীক দত্ত

অবতক- এর বিশেষ প্রতিবেদন-

একটি বায়োস্কোপ ও একটি মানুষ
তমাল সাহা

বাংলার বাস্তব জীবনের ধ্রুপদী নির্মাণের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বিরুদ্ধ চেতনার মিশেল দিলে নির্মাণটি নিশ্চিত অন্যমাত্রা পেয়ে যায়। দারিদ্র জীবনেরই একটি অঙ্গ। প্রকৃতির সঙ্গে ঋক জীবন ঋদ্ধ এই বাংলার দৃশ্যপট, গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতি একাকার করে আন্তর্জাতিকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের নয়া অভিয়ান চালিয়েছিলে তুমি– সত্যজিৎ রায়।
তোমাকে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি বায়োস্কোপের সঙ্গে একটি মানুষ কিভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যায় তা প্রদর্শিত হলো অপরাজিত নির্মাণে।

একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে চিন্তনের লড়াই ও সংগ্ৰাম যা রীতিমতো যুদ্ধ তাতে নিশ্চিত সেনাপতির ভূমিকা নিয়েছিলে তুমি। আর একটি নির্মাণ যে কারখানা তাতে যে কলাকুশলীদের ও নির্মাণ, কারিগরদের যৌথ শ্রম,ঘাম চিন্তন নিবেদিত তার উপাখ্যান রচনা করেছেন অপরাজিত ছবির নয়া কারিগর– অনীক দত্ত।
তাঁর দৃষ্টির প্রাঞ্জলতা,সময়ের সঙ্গে তাঁর ক্রিয়াশীল অনুভব,বাম চেতনার দূরদৃষ্টি ধ্রুপদী ও বাণিজ্যিক সিনেমার ফারাক সবই তুলে ধরেছেন চলচ্চিত্রের এই নব ওস্তাগর। চলচ্চিত্র নির্মাণে অর্থের প্রয়োজন থাকলেও সেটা ব্যাটেলশিপ অব পটেমকিন ছাড়া আর নতুন কিছু কি, চলচ্চিত্রের অগ্রগমনের জন্য এক যুদ্ধ তা যখন পথের পাঁচালী থেকে পদাবলী হয়ে ওঠে তখন রাষ্ট্রীয় বিরুদ্ধতা নিশ্চিত। পথের পাঁচালী যদি জীবন পথের পদাবলী হতে চায় তবে তো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঝুঁকি নিয়ে তা নির্মাণের স্পর্ধা দেখাবেই নব কারিগরেরা।

মহা করোনার এই প্যানডেমিক পরিবেশের জন্য শতবর্ষে শ্রদ্ধা জানাতে পারি নি আমরা সত্যজিৎ রায়কে। অপরাজিত-র এই নবনির্মাণ রাষ্ট্রীয় বিষ নজরে পড়েছে, এ সন্দেহাতীতভাবে সত্য। নিউ রিয়ালিজমকে আরো এক ব্যতিক্রমী বার্তায় পৌঁছনোর চেতাবনি দেখিয়েছেন অনীক দত্ত। চরিত্রগুলি ছদ্মবেশ ধারণে সক্ষম হলেও কুশীলব এমন কি কাহিনীকারের প্রকৃত মুখগুলি নির্মাণ প্রকৌশলীতে মূর্ত হয়ে ওঠে। কিসের জন্য চলচ্চিত্র? কাদের জন্য চলচ্চিত্র? চলচ্চিত্রের নির্মাণ পদ্ধতি কি?– তা সাধারণজনকে সমৃদ্ধ করবে এই চলচ্চিত্র নির্মাণ নিশ্চিতভাবে।

অপু প্রকৃত অর্থেই মানিক। দুর্গা উমা, সর্বজয়া সর্বমঙ্গলা, হরিহর হরিমাধব, বোড়াল গ্রাম সরাল গ্রাম, কালজয়ী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিবরণ মুখোপাধ্যায় এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণের কুশীলবরা তাদের নাম অন্য নামে রূপান্তরিত করলেও সত্যজিৎ রায় মানিক হয়ে চলে আসেন অপরাজিত-তে।
সাধারণ মানুষজন দেখে চলচ্চিত্রে বাংলার পরিবেশ বিমূর্ত হয়ে ওঠে। বৃষ্টি কৈশোর জীবনের যে একটি অনুষঙ্গ, প্রকৃতির বিমুগ্ধতায় কৈশোর যে আনন্দমুখর,রেল গাড়ি যে চলমান জীবনের অব্যক্ত অভিব্যক্তি, শব্দ যে নতুন জীবনের আহ্বান, রেল লাইন দেখার অনুসন্ধিৎসা আর কাশ ফুলের গাছ যে জীবনে একটি জরুরি অনুষঙ্গ সেটিও মুন্সিয়ানার সঙ্গে দেখান নব চিত্রপরিচালক। কিভাবে সংগ্রামী সত্যজিৎ রায় শব্দ সুরকে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিয়েছিলেন, যান্ত্রিক অনুষঙ্গ জীবনের সঙ্গে একটি আশ্চর্য এবং ধ্রুপদী অনুভব তার পুনরুত্থান ঘটিয়েছেন নব চলচ্চিত্রকার।

কোন খাতের টাকা কোন দিকে যায়–রাষ্ট্রীয় অপকৌশলকেও সূক্ষ্মতার সঙ্গে প্রবেশ বা অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দিয়ে দর্শককুলের মধ্যে একটি রাজনৈতিক চেতনার সংঘাত সৃষ্টি করেছেন এটা অনস্বীকার্য। নব প্রজন্মের কাছে এই চলচ্চিত্রটি দেখা অর্থাৎ পথের পাঁচালী এবং পথের পদাবলীর মধ্যে ওই যে একটি দ্বান্দ্বিকতা রয়েছে সেটি সংলাপের উপলব্ধে নবপ্রজন্মেরা একটি দিশা খুঁজে পাবেন। এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ নিশ্চিতভাবে একটি স্পর্ধিত এবং সত্যজিৎ রায়ের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদন।

অপরাজিত জীবনের চলমান চিত্র–দেখা উচিত এবং কর্তব্য। রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও প্রহরা কোন সাংস্কৃতিক চেতনাকে কোনোদিনও রুদ্ধ করতে পারে নি, কোনোদিনও পারবে না।