অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ
সময়ের নাটক, নাটকের সময়
তমাল সাহা

নাটক কি শুধু মঞ্চেই সীমাবদ্ধ,অভিনীত হয়? সংলাপ কি শুধু কুশীলবের মুখেই মানায়? চেতনা শব্দটির অভিমুখ কি? সে কি শুধু অভিনেতার বলিষ্ঠ অভিনয়ের মধ্যেই পরিকীর্ণ থাকে? এরিনার পরিধিতে যারা উপবিষ্ট তাদের দৃষ্টি ও মনন গ্রাহ্য হয়ে ওঠে না? এইসব চিন্তনের আলোড়নের ঘূর্ণি ওঠে স্নায়ুকেন্দ্রে। যখন পরপর দুটি নাটক দেখি– দৃষ্টি শ্রবণ এবং সংলাপের উচ্চারণ ও অভিনয়কে সমন্বিত করে।

সময়ের নাটক

এখনই তো নাটক নামানোর সময়। বারংবার অভিনয়ের সময়। গাঢ়তর অন্ধকারেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নক্ষত্রগুলি জ্বলতে থাকে।তাকে নির্বাপিত করতে পারে কে? রাষ্ট্রীয় পরিসরে মধ্যবিত্ত চেতনায় অধ্যাপক ঠিকেদার পর্যটনবিলাসী নিজেদের পেশার চেয়ে আর্থিক ভাবনা, পারিবারিক মনস্তত্ত্ব, দাম্পত্য দ্বন্দ্ব মাথায় থাকলেও ধর্মীয় বৈষম্য তাদের জীবনকে কিভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং সেটিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তা দেখায় এই নাটক। একটি ব্যক্তিবাচক বিশেষ্য পদের কারণে কিভাবে বাসযোগী পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ে,সংহতি সম্প্রীতি বিপন্ন করে তোলে, দৃষ্টিকে অসভ্য সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করে এবং বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন চলে, দ্বিধাদ্বন্দ্বে টালমাটাল হয়ে ওঠে সেই বন্ধুতা তার শল্য চিকিৎসা করে এই নাটক। নিজেদের পরস্পর চেনা,যে পরিচয় দীর্ঘকালীন — এই যে সম্পর্ক সেখানেও যে যথার্থ চেনাজানা সম্পূর্ণ সম্পন্ন হয়নি তা এই নাটকে বাস্তব প্রতিফলন ঘটায়। সেই সম্পর্কে ঝড় তোলে।

ততক্ষণে বাইরে বিদ্যুৎ বজ্রপাত সহ ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে।
একটি শব্দ মাত্র একটি নাম মাত্র ,তার কারণে আশ্রয় জোটে না। আবার সেই নাম পণ্যজাত হয়ে ওঠৈ। তাকে কেন্দ্র করে আর্থিক সুবিধায় ঠিকেদারি পাবার একাগ্ৰতা চলে, মনোনিবেশ চলে। নামও পণ্য। তার নিজস্ব নিয়মে বড় হয়ে ওঠে। এদেশে নামের কারণে মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে না। একটা আবাসিক হোটেল, হোটেল হয়েই থাকে, তা আশ্রয় তীর্থ হয়ে ওঠে না। রবীন্দ্রনাথকে তির্যক দৃষ্টিতে ক্রমাগত ব্যঙ্গ করতে থাকে। অভিনয়ে দুই বন্ধুর ( কৌশিক — সুদীপ্ত দত্ত, সুলেমা- শুভাশিস দাস) বিশ্লেষণধর্মী সংলাপ মননের অভিব্যক্তি অবশ্যই তাৎপর্যবাহী। অন্যান্য অভিনেতারাও বর্তমান সামাজিক পরিবেশে নিজস্ব বাস্তব ভাবনার প্রতিফলন প্রকট করে তুলেছেন। তাই এই নাটক সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে।

নাটক ডলার ও অন্যান্য/রচনা হর ভট্টাচার্য্য / নির্দেশনা সুদীপ্ত দত্ত/ প্রযোজনা গয়েশপুর সংলাপ।

প্রতিস্পর্ধার নাটক

তুমি যতই রাষ্ট্রীয় শাসনের কৃত্রিম ঝড় তোলো হে শাসক, যতই রক্তপাতের দিকে ধাবিত হও, ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকবেই। জন হেনরির গান স্তব্ধ হয় না, স্তিমিত হয়না, নির্বাপিত হয় না। চলতেই থাকে।
দেশে দেশে মানব বিপন্নতাই ফ্যাসিবাদ। শব্দ আলোর আবহে হৃদয় অভিঘাতী সংলাপের উচ্চারণ,চলমান অভিনয়ে তিনজন কুশীলব কিভাবে একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ও অগণতান্ত্রিক রূপ তুলে ধরতে পারে তা দেখিয়ে দিয়েছে কাঁচরাপাড়া কৃষ্টির দুর্দান্ত অভিনেতারা। শুরুতে এবং সমাপ্তিতে জন হেনরির গান গেয়ে মঞ্চ-পরিবেশকে সজীব করে তুলেছেন গৌতম ঘোষ।

একজন প্রৌঢ় ক্ষৌরকার(ক্যামিলো– সুদীপ্ত দত্ত) আসলে তার বৃত্তির চেয়ে বিপ্লবকে বেশি ভালোবাসেন। তার হৃদয় জারিত একটি স্বপ্ন বিপ্লব। সম্যক ভাবনায় কিভাবে তিনি বিপ্লবী শক্তির সহযোগী হয়ে উঠবেন আর সদ্য তরুণ বিপ্লব চেতনায় জারিত হলে তার বুকের অলিন্দে সঞ্চিত করে রাখে অগ্নিভ সৃজনশীল প্রেম ও প্রতিবাদে অভিযোজিত উচ্চারণ তার উন্মোচন ঘটায় বোমেরো( আকাশ প্রসাদ)। তার আবেগ উত্তেজনা পার্টির জন্য কমরেডদের জন্য, নিপীড়িত মানুষের জন্য তা একাকার হয়ে যায়।
আর ফ্যাসিস্ট কমান্ডার টোররেস( সমরেশ সাহা) শৈল্পিক অভিনয় বিভঙ্গে আঙ্গিকের প্রকাশে হিটলারীয় ব্যবস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে।

তারুণ্য তো মরে না! আবার প্রাণময় হয়ে ওঠে। তখন বয়স্ক ক্ষৌরকার প্রবীণ হয়ে ওঠেন,হয়ে ওঠেন যৌবনের প্রতিনিধি। তখন তিনি নতুন করে চেতনায় শান দেন। তিনি উপলব্ধি করেন, ক্ষুরে শুধু শ্মশ্রু উৎপাটন করা যায়, শত্রুকে-রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সমূলে ধ্বংস করে সৃজনের আয়োজনে বাংলা ভাষার দুটি স্বরবর্ণের মাত্র প্রয়োজন,অ-এ অস্ত্র, আ-এ আগুন।
তিনি অস্ত্র শানে আগুনের সাহায্য নেন। আরো বড় অস্ত্র নির্মাণের স্ফুলিঙ্গ উড়তে থাকে মঞ্চ জুড়ে।

নাটক ফেনিল/রচনা নির্দেশনা অনুপ রায়/ প্রযোজনা কাঁচরাপাড়া কৃষ্টি।

দুটি নাটকেই আলোর কারিগরি মনোজ প্রসাদ

প্রদর্শন মঞ্চঃ কল্যাণী নাট্য চর্চা কেন্দ্রের স্টুডিও থিয়েটার কক্ষ, কল্যাণী। ২৯ মে, ২০২২