কাঁচরাপাড়া নগর জীবনের রূপকার এবং শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ, স্বাধীনোত্তর পর্বে কাঁচরাপাড়ার জনপদে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সঙ্গে যুক্ত রাসবিহারী শাস্ত্রীর আবক্ষ মূর্তি আজ প্রতিষ্ঠিত হবে কাঁচাপাড়া পলিটেকনিক উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যানিকেতনটির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সভাপতি ছিলেন তিনি।

শাস্ত্রী মশাই
তমাল সাহা

আলোক স্তম্ভ সোজা দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথায় তাকে বাতি। বাতি থেকে সেই আলো সরলরৈখিকে মাটিতে বিস্তৃত হয়। একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল আলোকিত হয়ে পড়ে। তিনি অনেকটা আলোক স্তম্ভের মতোই ছিলেন । তিনি যতো না কংগ্রেসি বা কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন স্বদেশি, স্বজাত্যবোধে সম্পৃক্ত একজন মানুষ। তাঁর মুখনিঃসৃত তথাকথিত রাজনৈতিক ভাষণের শ্রবণসুযোগ আমার হয়নি। আমি শুনেছি তার শিক্ষামূলক চৈতন্যের সহজ কথা। আর একের পর এক জনপ্রকল্পের কথা যেমন উদ্বাস্তু সমস্যা কলোনির উন্নয়ন নিষ্কাশন ব্যবস্থা, এসবই তিনি বলতেন।
আর রাজনৈতিক সম্প্রীতি, সংহতি! সে তো তিনি সেই ১৯৫১ সালে ইস্কুলের পুরস্কার বিতরণী সভায় তার দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন। রামকৃষ্ণ মিশন, জনসঙ্ঘ, বৈপ্লবিক আদর্শে অনুপ্রাণিত ব্যক্তিত্বদের আমন্ত্রণ করে হাজির করেছিলেন। তাতে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, স্বামী পুণ্যানন্দ, বন্দেমাতরম ও দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় সম্পাদক এবং জাতীয় আন্দোলনের পরামর্শদাতা হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ।

পঞ্চদশীয় বয়স থেকে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। কাছে গিয়ে বুঝেছি তার অস্ত্র দুটি– এক হাতে শিক্ষা, অন্য হাতে পরিষেবা। তাঁর ইস্কুলের গণ্ডিবদ্ধ ছাত্র ছিলাম না আমি। আসলে তিনি ছিলেন সর্বজনীন সার্বজনীন শিক্ষক। ওয়ার্কশপ রোড ও রজনীবাবু রোড সংলগ্ন তাঁর আশ্রয়ে সহজেই যাওয়া যেত। আসলে তিনি ছিলেন কারিগর বা ওস্তাগর। নতুন করেও গড়তে পারতেন, কেটে ছেঁটেও তৈরি করে নিতে জানতেন। কাঁচরাপাড়া হার্নেট হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন তিনি। ইংরেজি পড়াতেন। সেই ইস্কুল ছেড়েও চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি কাঁচরাপাড়া পলিটেকনিক হাই স্কুল গড়ে তুলেছিলেন নিজের হাতে এবং প্রতিষ্ঠাতা পরিচালন সভাপতি হয়েছিলেন। তিনি ঠিক এই ইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন না। আসলে ইস্কুলের জনক হিসাবে অপত্যদের দেখভাল করতে তিনি প্রায় প্রতিদিনই ক্লাস নিতে ঢুকে পড়তেন। আশ্চর্য অদ্ভুত এমন দ্বিতীয় মানুষ এই প্রান্তিক বেলা পর্যন্ত আমার দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি। বেতন? হা! হা!
তাহলে রোজগারপাতি? আসলে তিনি ছিলেন খল নুড়ি নিয়ে ব্যস্ত আয়ুর্বেদিক মানুষ। ভেষজ ওষুধ বানাতেন। কবিরাজ শাস্ত্রী মশাই। তাঁর প্রস্তুত ওষুধপত্র প্যাকেটজাত হতো। আর বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে পাঞ্জাবে চলে যেত। ওয়ার্কশপ রোডে পুরনো পোস্ট অফিস ছিল। সেই পোস্ট অফিস থেকে পার্সেলে সেইসব আরোগ্য-পণ্য দূরান্তে চলে যেত।

তিনি নগর প্রধান। নগর পরিষেবার দায় নিয়ে বসে আছেন। সাদামাটা পোশাক– ধুতি পাঞ্জাবি, কালো ফ্রেমের চশমা। যখন বাড়িতে থাকতেন সাদা ফতুয়া। ধীর হাঁটাচলা, স্বরও নিচু। ইংরেজি গল্প কবিতা প্রবন্ধ– কিছূ বুঝতে চাও তো শাস্ত্রী মশাইয়ের বাড়ি চলে যাও। রাস্তা দিয়ে হাঁটাচলা করলেই তুমি পরিষ্কার দেখতে পাবে চেয়ারে বসে আছেন শাস্ত্রী মশাই, সামনে টেবিল।

স্বাধীনতার পর এই জনপদে যত ইস্কুলের পত্তন হয়েছে সেখানেই জড়িয়ে গেছেন শাস্ত্রী মশাই।
নারী শিক্ষা এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষার দিকে তাঁর নজর ছিল। ‌ দুপুরে পলিটিকনিক বয়েজ স্কুল, তো তিনি ভাবলেন সকালে স্কুল ফাঁকা যায় কেন, বানিয়ে দাও মেয়েদের ইস্কুল। নাম রাসবিহারী বলে কথা! যেমন কথা তেমন কাজ।

দায়বান মানুষটি কাঁচরাপাড়ায় জল সরবরাহের জন্য অধীর উতলা। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ বাগ্বিতণ্ডা আমাদের জানা আছে। বিধান রায় কাল বিলম্ব না করে বাধ্য হয়েছিলেন শাস্তির মশাইয়ের প্রকল্পের রূপদানে।

এই ইস্কুলকে নিয়ে কথা হচ্ছে, আসলে কতজন জানে এই স্কুলটি তাঁর জেদের সদর্থক ফসল? এই ইস্কুল সরকারি অনুমোদনের জন্য তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলের কথা আমরা জানি।

বামুনের ছেলে বামুন হয়। চেয়ারম্যানের হাতে গড়া শিষ্যও চেয়ারম্যান হয়। স্বাধীনোত্তর কালের চেয়ারম্যান তিনি। তিনবার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। হার্নেট স্কুলে তাঁর হাতে তৈরি হওয়া কমিউনিস্ট নেতা অমূল্য উকিলও এই জনপদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। কংগ্রেসের হাতে তৈরি কমিউনিস্ট নেতা!

বই হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যদি বলা হতো, স্যার মে আই কাম ইন! তিনি খুব খুশি। তিনি বলতেন, মে আর ক্যান-এর মধ্যে পার্থক্য বুঝিস তো? মে-র বদলে ক্যান-এর উপর বেশি গুরুত্ব দিবি, মে-র বদলে মাস্টের দিকে ঝুঁকবি বেশি।

তাঁর পরবর্তী পৌর প্রশাসনিক কালে এই মানুষটি কোনো গুরুত্ব পায়নি কোনো আমলেই। শুনে রাখো শাস্ত্রী মশাই! আমাদের কিন্তু তোমাকে মনে আছে।

তোমার শবযাত্রায় কজন মানুষ হয়েছিল সে কথা বলতে আর আগ্রহ বোধ করিনা। বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি।
নতশিরে তোমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছি।