এই জনপদে ঝড়ো দিনগুলিতে সলিল চৌধুরী

তমাল সাহা

সলিল চৌধুরী জন্মেছিলেন ১৯ নভেম্বর,১৯২৫

জনমঞ্চ থেকে গান গাইতে গাইতে চলে গিয়েছিলেন অন্য এক প্রবাসী লোকে ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫।

এই নাগরিক জীবনে সুজন আপনি নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবেন যখন শুনবেন– অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি/ জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি– কবিতাটি গান হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে কাঁচরাপাড়া হালিসহর অধ্যুষিত অঞ্চলে। আর তা গাইতে গাইতে হেঁটে চলেছেন স্বয়ং সলিল চৌধুরী।

নিশ্চিত এ ছাড়াও কত গণসঙ্গীতই না গাইতেন তিনি তখন, যখন গণসঙ্গীতের ক্লাস নিতে আসতেন এই শহরতলিতে। আরও নিশ্চিত সেই গানের আসরে থাকতেন শ্রীপদ সেনগুপ্ত, সুধীর মুখার্জি, সুধীর ব্যানার্জী, শিপ্রা চক্রবর্তী, শুক্লা চক্রবর্তী, সতীন চক্রবর্তী, কার্তিক কুন্ডু, ননী দে, মায়া চ্যাটার্জীর মতো কমিউনিজমের আদর্শে বিশ্বাসী শিল্পীরা।

সলিল চৌধুরীর কন্যা অন্তরা চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘বাবা সলিল চৌধুরী ছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যর বন্ধু। সুকান্ত সলিল চৌধুরীকে বলেছিলেন, যদি সম্ভব হয় কোনোদিন আমার কবিতাকে গানে রূপান্তর করা যায় কি না দেখিস ভাই!’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কেও একথা বলেছিলেন সুকান্ত। তখন কি সুকান্ত সলিলের কাছে এই পংক্তিদুটি উচ্চারণ করেছিলেন– রানার রানার ভোর তো হয়েছে — আকাশ হয়েছে লাল/ আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল!

প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন সলিল। সুকান্তর মৃত্যুর আগেই রানার কবিতার সুরারোপ করেন এবং তা কবিকে শোনান। কবি সুকান্ত খুবই মুগ্ধ এবং আপ্লুত হয়েছিলেন রানার গানের সুরে। কে গেয়েছিলেন? সেই কবিতাকে গানের সুরে এনে ঝড় বইয়ে দিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সুকান্তর ‘ঠিকানা’ কবিতাটিও সুরসমৃদ্ধ হলো সলিল চৌধুরীর নৈপুণ্যে এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে।

আর সমগ্র দেশকে অবাক করে দিয়ে সলিলের সুরে সুকান্তর ‘অবাক পৃথিবী’ ঋজু উচ্চারণে গেয়ে উঠলেন সেই ব্রাত্যজন জর্জ দেবব্রত বিশ্বাস। সেসময়ের কমিউনিস্ট পার্টির সভা সমিতিতে এই গানটি উদাত্ত কণ্ঠে গাইতেন দেবব্রত বিশ্বাস।

কমিউনিস্ট পার্টির সেই উত্তাল সময়ে নৈহাটি আইপিটিএ -র মূল কান্ডারী সলিল বসু। সেখানে আসতেন সলিল চৌধুরী। আসতেন শ্যামল মিত্রের বাড়ি মিত্তির পাড়ায়। সেই মিত্তির পাড়ায়ই তো সলিল ঝড়ের কাছে রেখে গেলেন নিজের ঠিকানা। এই আইপিটিএ-র সেই গানের স্কোয়াডে থাকতেন গৌরী বসু, সাহিত্যিক সমরেশ বসুর সহধর্মিণী। হালিসহর মালঞ্চের চিনুদার বাড়িতেও গণসঙ্গীতের রিহার্সাল হতো। সেইসময় কোনো কোনোদিন সলিল চৌধুরীর সঙ্গে থাকতেন আরেক স্বনামধন্য গীতিকার সুরকার পরেশ ধর।

আর কাঁচরাপাড়া? সে তো শ্রমিক মহল্লা। তখন শ্রমিকরা তেল-কালি-ঝুলি মাখা কামগার। সিদ্ধেশ্বরী লেনের শৈলেন চ্যাটার্জীর মাটির বাড়ি রীতিমতো কমিউনিস্টদের আখড়া– বাম চেতনার আঁতুড়ঘর। সেই ঘরের মাটির দাওয়ায় বসে আছেন সলিল চৌধুরী। হেই সামালো! হেই সামালো! /হেই সামালো ধান হো!/ কাস্তেটা দাও শান হো! অথবা

তাই দেশে দেশে যত প্রতিরোধ/ তারই মাঝে তুলি যত রক্তের স্রোত/ নানকিং আর প্যারির যুদ্ধে আমরাই সাথে আছি কাকদ্বীপে / মরে আমরা আবার তেলেঙ্গানায় বাঁচি।

গলা মেলাচ্ছেন শ্রীপদ, ননী, শিপ্রা, শুক্লারা।

 

সে একদিন। যখন জীবন ছিল স্বপ্নের মতো। অবাক হতো রাতের তারারা। আকাশে মিটমিট করে চাইতো। কাঁপা পেরিয়ে শিবদাসপুরের মেঠো অঞ্চলে, জেঠিয়ার গাছগাছালির লোকালয়ে কোনোদিন শোনা যেত উদ্দাম গণসঙ্গীতের কলরব। নেতৃত্ব দিচ্ছেন সলিল চৌধুরী।

এলো ১৯৫২সাল। ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম নির্বাচন। সেবার জেঠিয়া বাজারে হলো জনসভা। বক্তা তেভাগা আন্দোলনের নেতা কংসারী হালদার। সভা শুরু হলো সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে। সলিল চৌধুরীর সঙ্গে গান গাইছেন গৌরী বসু, সাহিত্যিক সমরেশ বসুর স্ত্রী। পেছনে তখন গলা মেলাচ্ছেন একদল কিশোর। তাদের মধ্যে ছিলেন আজকের নজরুল গবেষক বাঁধন সেনগুপ্ত। বাঁধন সেনগুপ্ত জানালেন, :সলিল চৌধুরীকে আমরা বাচ্চুদা বলে ডাকতুম। গণসঙ্গীতে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী সেসব এখন ধুসর স্মৃতি। হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে আমরা নিয়ে এসেছি ‘গণকণ্ঠ’- এর অনুষ্ঠানে এই হালিসহরে।’

এই অঞ্চলের স্বনামখ্যাত আবৃত্তিকার কাজল সুরও নিজের আবৃত্তি চয়নে রেখে দিয়েছেন সলিল চৌধুরীর “চাবি” কবিতাটি।

তোমাকে নিয়ে কতসব কাহানি, কমিউনিস্ট পার্টিতে কত বিতর্ক, কত সব গল্পকথা– মনে পড়ে সেই সব দিন‌। বেরোলো গ্রেফতারি পরোয়ানা। সুন্দরবনের জল-অরণ্যভূমিতে আশ্রয় দিয়েছিল মাটির মানুষেরা। কৃষকরা তোমাকে কাছের করে নিয়েছিল। তোমার হেই সমালো ধান হো, পথে এবার নামো সাথী কতসব জীবন উজ্জীবনের গান!

সলিল চৌধুরী হয়তো অলক্ষ্যে থেকে অনাগত দিনটির সুনিশ্চিত আগমনী সংবাদ দিয়ে চলেছেন– বন্ধু আজকে বিদায়/ দেখেছো উঠলো যে হাওয়া ঝড়ো/ ঠিকানা রইল এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা করো।