১২ জানুয়ারি, মাস্টারদা সূর্য সেনের মৃত্যুদিনঃ তাঁকে স্মরণ

অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন

কাঁচরাপাড়ায় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নায়কদের আগমন

অবতক খবর,১৪ জানুয়ারিঃ মানুষের বিশেষ করে বাঙালির ক্ষোভ দুঃখ হওয়া স্বাভাবিক। একজন বিশ্বজয়ী পরিব্রাজক, তাঁর জন্মদিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে,সাড়ম্বরে পালন করা হবে অথচ সেই বিশিষ্ট দিনটিতেই অর্থাৎ ১২ জানুয়ারি যে মানুষটি দুঃসাহস এবং স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সেই দিনটি তাঁর মৃত্যুদিন। ভারতের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম নায়ক যিনি অভাবনীয় যুগান্তকারী ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুদিন। তাঁর কর্মজীবন সম্পর্কে কেন প্রজন্মকে জানানো হবে না? সেটি কেন স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে স্বীকৃতি পাবে না, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটিতে?

যথার্থ দেশপ্রেমিক আত্মত্যাগে উৎসর্গীকৃত মাত্র কয়েকটি বৈপ্লবিক প্রাণ নিয়ে তিনি সশস্ত্র আন্দোলনের বনিয়াদ গড়তে চেয়েছিলেন এবং সক্রিয় হয়েছিলেন। তিনি মাস্টারদা সূর্য সেন। এবার তাঁর সম্বন্ধে কাঁচরাপাড়াকে সঙ্গী করে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা লিখি।

কাঁচরাপাড়া মাস্টারদা সূর্য সেনকে দেখেনি, দেখেছে তাঁর সহযোদ্ধাদের। কাকে কাকে দেখেছে? দেখেছে অন্য তিন নায়ক অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিংকে।
কাঁচরাপাড়ার মাটি খুঁড়লে এমন অনেক ইতিহাসই বেরিয়ে আসবে।

১৮ এপ্রিল,১৯৩০।চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন। জেল খাটছেন নায়করা। বোমা বানানোর ব্রিলিয়ান্ট বয় অনন্ত সিং, মাস্টারদার ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মির ফিল্ড মার্শাল গণেশ ঘোষ আর অস্ত্রাগার লুন্ঠনের দিন টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা ভেস্তে দেবার মাস্টার অম্বিকা চক্রবর্তী— এই তিনজনকে কাঁচরাপাড়ার মানুষরা প্রকাশ্যে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু মাস্টারদাকে পাননি কারণ মাস্টারদা তখন আর নেই। তিনি বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে চলে গিয়েছেন অনেক দূরে ১২ জানুয়ারি,১৯৩৪-এর গোপন রাত্রিতে।

তাঁর ভয়াবহ মৃত্যুর কথা, তাঁর প্রতি লালমুখো ইংরেজ যে কী অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল সে এক বীভৎস বিবরণ। মৃত্যুর আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল। মৃত অবস্থায় তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। বিশ্বের ইতিহাসে এটি একটি অন্যতম ঘটনা। তাঁর পায়ের আঙুল, হাতের আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। তাঁর দাঁতের পাটি ভেঙে দিয়েছিল ইংরেজ ডালকুত্তারা। মাস্টারদা যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সমূলে উৎপাটিত করবার চেষ্টা করেছিলেন তার প্রতিশোধ এই অত্যাচারী ইংরেজ এমন পৈশাচিক ও হিংস্রভাবে নিয়েই তার নির্লজ্জতা প্রকাশ করেছিল।

ভারতবর্ষ স্বাধীনতার প্রাক মুহূর্ত। রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি আন্দোলন চলল পুরোদমে। ১৯৪৬ সাল।
তখন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দি। ছাড়া পেলেন এই রাজনৈতিক বন্দীরা। ছাড়া পাবার পরেই তাঁরা ঠিক করলেন বারাসাত যাবেন,সেই নারকেলবেড়িয়া।

বারাসাত কেন? সেই বাঁশের কেল্লা, তিতুমীর যে দুর্গ বানিয়েছিলেন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদকে রুখতে, তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে।

তিতুমীর একজন কৃষক নায়ক। বাঙালির আশ্চর্য বুদ্ধি! দুর্গ! তাও আবার বাঁশের! বাঁশ দিয়ে দুর্গ তৈরি করা যায় কেউ কি কখনও ভাবতে পেরেছে? কৃষক শোষণের বিরুদ্ধে আর জমি দখলের সেই সাচ্চা লড়াইয়ে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ধ্বংস করতে লালমুখো ইংরেজকে কামান পর্যন্ত দাগতে হয়েছিল। সেই হিম্মতদার লড়াকু তিতুমীরের শহীদ বেদীতে মালা দিতে যাবেন বিপ্লবীরা।

বিপ্লবীরা কাঁচরাপাড়া এলেন। কাঁচরাপাড়া স্টেশনের ১ নং প্ল্যাটফর্মের এপার থেকে তখন ২২ নং রুটের বাস ছাড়তো। ছাড়তো ৮৭ নম্বর রুটের বাস। ৮৭ নং রুটের বাস সরাসরি বারাসাত চলে যেত। তবে তার সংখ্যা অত্যন্ত কম ও সেই বাস একটা নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়তো।২২ নং রুটের বাস হরিণঘাটা পর্যন্ত যেত। সেখান থেকে আবার বারাসাত যাওয়া যেত। ঠিক হল সেই বাসে করে বিপ্লবীরা হরিণঘাটা যাবে।সেখান থেকে আবার বাস ধরে বারাসাত।

কাঁচরাপাড়া স্টেশনের ১ নং প্ল্যাটফর্মের বাইরে যেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহরটি শুরু সেই অঞ্চলে মঞ্চ বাঁধা হল। নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল বিপ্লবীদের। কারা দিয়েছিল? তখন সবে গড়ে উঠছে কমিউনিস্ট পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টিতে তখন ননী সেন, কুঞ্জ বসু, অমূল্য উকিলরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সব উজাড় করে দেওয়া শিক্ষক নিত্যানন্দ চৌধুরী রয়েছেন জেলা নেতৃত্বে। তিনি ঘনঘন কাঁচরাপাড়া আসছেন শ্রমিক সংগঠন গড়ে তুলতে। কাঁচরাপাড়া লোকো গেটের সামনে কাপড় মাথায় জড়িয়ে মেয়েলি ঢঙে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচ করে তিনি তখন শ্রমিক জড়ো করতেন।ভাবা যায়, জনগণের জন্য সমর্পিত প্রাণ এইসব বামপন্থীজনের কথা! ভাবলে বিস্ময় ও আনন্দময়
অশ্রু বয়ে যায়…
কামগার মানুষ জড়ো হবার পর তিনি ভাষণ দিতেন। লিফলেট বিলি করতেন। সঙ্গে অবশ্যই কমরেডরা থাকতেন।

যাই হোক, এই সংবর্ধনা সভায় কংগ্রেসকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো। শহরের সুধীজনদের আমন্ত্রণ জানানো হলো। উপস্থিত ছিলেন তুলসী দত্ত, মুক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখর মতো বিশিষ্টজনেরা। এটি ছিল সর্বজনীন সংবর্ধনা সমাবেশ।

সম্বর্ধনার প্রত্যুত্তরে বক্তব্য রাখলেন বিপ্লবীরা। কী সেই কন্ঠ? দেশকে ভালোবাসার উষ্ণ প্রস্রবণ।

আরো কিছু আছে? আছে। এই এই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের জন্য মাস্টারদা সূর্য সেনকে নগেন(জুলু) সেনের পার্ক স্ট্রিটের দোকান মারফত অস্ত্র সাপ্লাই করেছিল কে?
এই পিস্তল না পেলে অস্ত্রাগার লুন্ঠন সম্ভবই হতো না। সেই অস্ত্র জোগান দিয়েছিলেন হালিসহরের শিবের গলির অধিবাসী স্বাধীনোত্তর বীজপুরের প্রথম বিধায়ক পিস্তল সাপ্লায়ার আমাদের বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি।

তারপর? তার পরেও আছে।১৯ এপ্রিল,১৯৩০। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পরদিন একদা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একান্ত সচিব ও হালিশহর টাউন কংগ্রেসের সম্পাদক সুশীল ঘোষের বাড়িতে খানাতল্লাশি চালায় ইংরেজ পুলিশ এবং তাঁর দো-নলা বন্দুকটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। কলকাতায় তার আগেই সুশীল ঘোষ গ্রেপ্তার হয়ে যান। বারাকপুর মহকুমার পুলিশ অফিসার পি. এস. ফিনে রিপোর্ট দেন—Halisahar has become hot of revolutionary activities in Barrackpore Sub-Dvision.

এই সবই আমাদের গলা উঁচু করে বলবার মতো কথা।কাঁচরাপাড়ার কি মনে আছে বিপ্লবী গণেশ ঘোষের লেখা Chattal Brigade,সেই কবিতা?
…Slowly, slowly, mile by mile
march forward to the grave,
to the world of fame,
March forward on, youths the brave…