হালিসহর-কাঞ্চনপল্লীতে চৈতন্যদেব এসেছিলেন / তমাল সাহা

দোল পূর্ণিমা তিথি বসন্ত বাতাস
চুয়া চন্দন প্রেম
পথ সংকীর্তন জনতা মাতাস!

রে আমার গোপ-গোপী লয়ে মধুর খেলা
এখানে রয়েছে ঈশ্বরপুরী পাট চৈতন্যডোবা সতীমার মেলা!

হালিসহর-কাঞ্চনপল্লীতে চৈতন্যদেব এসেছিলেন
তমাল সাহা

ত্রাস ও সন্ত্রাসে তোমার কথা মনে পড়ে তুমি পৃথিবীতে আসবার পর ৫০০ বছরেরও কত বেশি বছর যেন পৃথিবীর বয়স বেড়ে গেছে। পৃথিবী কি বুড়ো হয়ে গেছে? তবুও আমাদের চৈতন্য হলো না। বোমাবারুদেব বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে গাঙ্গেয় প্রদেশ আর রক্তস্রোতে স্নান সেরে নেয় এই বাংলার মাটি। ভালবাসার বীজ মন্ত্র রোপন করার সংগ্রামে তোমার ভূমিকা ইতিহাস হয়ে যায়।
কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকীয় নির্মমতা তারুণ্যকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়, রাষ্ট্র তোমার জন্মভূমিকে বেচে দেয়, শাসক সুকৌশলে বসন্ত উৎসবকে লোকদেখানো মান্যতা দিয়ে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দেয় কিন্তু হে চৈতন্য! তুমি কি রাষ্ট্রের হৃদয়ে প্রজাপ্রেম জাগাতে পেরেছ?

এমন মানুষ কোনোদিন পা রেখেছিল এই বীজপুরের হালিসহরে, কাঞ্চনপল্লীর মাটিতে। কাঞ্চনপল্লীবাসী গবেষক অধ্যাপক সতীশচন্দ্র দে, গৌরাঙ্গদেব ও কাঞ্চনপল্লী গ্রন্থের লেখক, মহাশয়ের মতে সেটা ছিল কার্তিক মাস কৃষ্ণা ত্রয়োদশী বা চতুর্দশী ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দ। মহান প্রেমমন্ত্র তুমি ছড়িয়ে দিয়েছিলে সমগ্র ভারতবর্ষে। কুমারহট্ট হালিসহরের মানুষই তোমার কানে দিয়েছিল সার্বজনীন সর্বজনীন ভালোবাসার সেই মহামন্ত্র। পণ্ডিত নিমাই মিশ্র– বিশ্বম্ভর মিশ্র। তুমি যদি শিষ্য তো গুরু হলেন আমাদের ভূমিপুত্র ব্রহ্মবিদ পরিব্রাজকাচার্য ঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য, সুপরিচিত শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী।

ভারতবর্ষ সফর করেছিলে তুমি। ফেরার পথে পা রেখেছিলে হালিসহরের গুরুপীঠে তার নাম এখন ঈশ্বরীপাট। তখন গুরু চলে গেছেন মহাপ্রয়াণে ঊর্ধ্বালোকে। হয়তো তখন তোমার মনে পড়ে গিয়েছিল গয়ার কথা! গয়াধামে গদাধর র্মন্দিরে গদাধর পাদপদ্মে পিতার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদানের মুহূর্ত। সেই কালে এই মহাগুরুর কাছে তুমি নিয়েছিলে শ্রীকৃষ্ণ নাম মহামন্ত্রে দীক্ষা।
প্রভু বোলে গয়া করিতে যে আইলাঙ
তিই আজ সত্য হইল, ঈশ্বর পুরীরে পাইলাঙ।।
— চৈতন্য ভাগবত

মহান পিতা ঈশ্বর পুরীকে অদেখার সে কী কান্নাই না কেঁদেছিল তুমি ! গুরুর ভিটের ধুলোয় গড়াগড়ি খেয়ে সে কী আকুল ক্রন্দন!আর যাবার কালে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তুলে নিয়েছিলে এক খাবলা মাটি। গুরুপীঠের সেই মাটির গর্তই আজ প্রতীকী চৈতন্যডোবা হয়ে আছে।
তোমার পদধুলিধন্য এই অঞ্চলের মাটি চৈতন্যপ্রেমী মানুষ খুঁড়ে খুঁড়ে খাবলা করে তুলে নেয় পবিত্র মৃত্তিকা হিসেবে। জনশ্রুতি সেটাই শেষ পর্যন্ত ছোট্ট জলাধার চৈতন্যডোবাতে পরিণত হয়।

ভারত ভ্রমণ কালে নিমাই চৈতন্য।
গুরুর ভিটায় আসি হইলেন ধন্য।।
প্রভু বোলে কুমারহট্টের নমস্কার।
শ্রীঈশ্বরপুরী যে গ্রামে অবতার।।
কান্দিলেন বিস্তর চৈতন্য সেই স্থানে।
আর শব্দ কিছু নাই ঈশ্বর পুরী বিনে।।
সেই স্থানের মৃত্তিকা আপনে প্রভু তুলি।
লইলেন বহির্ব্বাসে বান্ধি এক ঝুলি।।
প্রভু বোলে ঈশ্বর পুরীর জন্ম স্থান।
এ মৃত্তিকা মোর জীবন ধন প্রাণ।।
— শ্রীচৈতন্য ভাগবত, আদি খণ্ড

তুমি এসেছিলে হালিসহর খাসবাটীর শ্রীবাস পণ্ডিতের বাড়ি আর এসেছিলে আমাদের কাঞ্চনপল্লীর কবি পরমানন্দ সেন বা কবিকর্ণপুরের বাড়ি। কবি কর্ণপুর তোমার আগমন সম্বন্ধে বিস্তর বিবরণ দিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে। তিনি লিখেছিলেন চৈতন্য চন্দ্রোদয় নাটক এবং শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত মহাকাব্য ।
তুমি আসবে। তাই খাসবাটীর শ্রীবাস পণ্ডিতের বাড়ি থেকে কাঞ্চনপল্লীর শিবানন্দ সেনের বাড়ি পর্যন্ত পথ সাজানো হয়েছিল। শিবানন্দ সেন ছিলেন কবি কর্ণপুরের পিতা। পথ সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন ভক্ত জগদানন্দ। নীলাচলে নৌকায় পাড়ি দিয়ে তুমি প্রথমে পানিহাটি পরে খাসবাটীতে উপস্থিত হয়েছিলে। সেটা ছিল ১৫১৪ সাল, কার্তিক মাস, কৃষ্ণা ত্রয়োদশী বা চতুর্দশী। সেখানে শ্রীবাস পণ্ডিতের বাড়িতে ছিলে কয়েকদিন। তারপর ঈশ্বরপুরীর ভিটেতে এলে। সেখান থেকে চলে গিয়েছিলে কবি কর্ণপুরের বাড়ি। তোমার আগমনে সে ছিল এক মহাসম্মিলন! এরপর তুমি আবার নৌকাযোগে শান্তিপুরে অদ্বৈতাচার্যের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলে।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে তোমাকে লোকশিক্ষক এবং সংস্কারমুক্ত মানুষ বলে অভিহিত করা হয়। তুমি এসেছিলে এই জনপদের ধুলো মাটিতে কয়েকশো বছর আগে। ধূসর স্মৃতি কাঁচের মতো স্বচ্ছ হয়ে আসে। গর্বে বুক ফুলে ওঠে এই জনপদের।

সামনে চৈতন্য ডোবা, অদূরে ঈশ্বরপুরীপাট
ছবি মণি ভট্টাচার্য