অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন

পর্ব-৭
বীজপুরের পটুয়াপাড়া

হ,অগো প্যাটের দানাপানির মজুরিই দিতে পারুম নাঃ অমর পাল।

হ, দাসপাড়া।‌ভাগাড়েরই এই অংশ । এইখানেই আমরা ঠাকুর বানাই। আপনারা যারে কন প্রতিমা।

এই কাম করতে করতে ৭০ বছরে আইয়া পড়ছি। এখন মাজা ধইরা যায়, ব্যথা হয়। সেইভাবে আর কাম কাইজ করতে পারিনা। আমার পোলাই দেখভাল করে। ওই আমি টুকটাক সাহাইয্য করি। প্রথমের দিকের কিছু কাম করি। বাঁশ চাঁছি,এইসব কাম করি। তবে এখন চক্ষুদানটা আমার পোলাই করে। এইবার অবস্থা খুবই খারাপ। সরস্বতী পূজার পর পর বড় প্রতিমা বানাইছিলাম। সব রইয়া গেছে। আপনেরা কন, পটুয়া পাড়া, কুমোরটুলি। কেউ কেউ আবার কয় এইটা নাকি স্টুডিও। জানিনা, আমরা অত কিছু বুঝি না।

আজীবন তো মাটি লইয়াই কাম করলাম, মাটি ছাইন্যাই গেলাম,মা বানাইলাম, মূর্তি বানাইলাম। আপনেগো প্রশংসাও পাইছি। “অমর পালের ঠাকুর,এমনও শুনছি। অমর পালের ঠাকুর তো! খুব সুন্দর করে।’—খারাপ লাগে না, শুনতে ভালই লাগে।

এইবার লকডাউন সব মাইরা দিছে। সরস্বতী পূজার পর পর বড় ঠাকুর বানাইছিলাম প্রায় ২০-২৫। একটাও বায়না হয়নাই, পইড়া রইছে। সব টাকা সেইখানে গেছে। প্রায় ১৬ জন কারিগর লইয়া কাম করছিলাম। কিন্তু কি হইল, কি যে আইল,কি যে করোনা!কেউ কয় কোভিড! এখন তো এই সবও বুঝি না। লকডাউন, বাইরের থিকা শিল্পীরা আসে, কারিগররা আসে। ‌তারা কাম কইরা দিয়া যায়। তারা আর আইতে পারতাছে না,ট্রেন চলে না। কি মজুরি দিমু? এখন ত্রিশটার মত ঠাকুর বানাইছি। বাবুরা আইয়া কয়,ছোট ঠাকুর চাই।কম বাজেটের পূজা। এই ছোট ঠাকুর বানাইছি, বায়নাও হইছে কিছু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি খরচাপাতি উঠব আমি কইতে পারুম না।

এখনো দ্যাখেন, এই যে দেখতাছেন কারিগররা কাজ করতাছে, আমি বাঁশ চাঁছতাছি। ছোটবেলার থিকাই কাম করছি,আসামে কাম করছিলাম। আসাম থিকা আইয়া এইখানে ছিটা বেড়া দিয়া, মাথায় টালি দিয়া ঘর করলাম। এইখানে আইয়া আমি আশু পাল,এস কে পপাল,জে পালের কাছে কাম শিখছি। তারা আমার গুরু।– ‌এই বলে অমর পাল কপালে একটা হাত ঠেকিয়ে প্রণাম ঠুকলেন।

শিল্পী বলে চলেন, বাঁশের দাম বাড়ছে, মাটির দাম বাড়ছে,সুতলির দাম বাড়ছে। সবই বাড়ছে,খালি আমাগো মজুরি বাড়ে নাই। আমগো দ্যাখনের কেউ নাই। এই যে আপনি জল পাড়াইয়া আইলেন,এই যে বৃষ্টিতে এক হাঁটু প্রায় জল,মানে এক হাঁটু কইলে হয়তো বেশী মনে হইবো, ওই হাঁটু থিকা নিচে পর্যন্ত জল,এই জল সরাইয়া যে কাম করুম,তার উপায় নাই। জল সরাইবার লিগা একটা পাম্পও নাই। আপনে তো নিজের চোখেই দ্যাখতাছেন ঘরে জল ঢুইকা গেছে। কাম করতাছি।

মজুরির কথা জিজ্ঞাসা করলে অমর পাল বলেন, যারা বিচালির কাজ করে,ঠাকুর প্রথমে বানধে তাগো আর যারা দো মাইটা করে তাগো মজুরি বেশি,১৬ হাজার ১৮ হাজার টাকা। দ্যাখা যাউক এইবার কি হয়, মা কতদূর লইয়া যায়! আর যে ছোট ঠাকুর গতবার ১৮ হাজারে বিক্রি করছি, সেইটার দাম নাইমা আইছে ৭ হাজার, ৮ হাজার,কোনটা ১০ হাজারে মানে অর্ধেক দাম। এই কইরা আর কতদিন চলবো?
আমার
ঠাকুরের দাম আরধেক আর আমার জীরনও আরধেক পার হইয়া তিন পোয়া হইয়া গেল! জানিনা করোনা কতদূর লইয়া যাইব!এই যে কারিগর, তাগো লইয়া এই যে কারবার জীবনের কারবার প্যাটের কারবার। এই কারবার কতদিন করতে পারুম,কে জানে?

বড় বড় বাবুর আইয়া কয়, এইটা নাকি শিল্প। শিল্প কথার মানেও বুঝি না, এই শিল্প আমি কিছুই বুঝিনা। ‌আমরা খাইট্যা মাটি দিয়া মা বানাই, এইটুকুই জানি,মারে আমরাও প্রণাম করি। যারা কিনা লইয়া যায় তারাও প্রণাম করে। জানিনা এই প্রণামের পর আমরা কিছু প্রণামী পামু কিনা! শেষ জীবনের কানাকড়ি কি হইবো কে জানে? ‌

সারা জীবন তো মা ই বানাইয়া গেলাম! মাত্র একটা মা আমার জন্ম দিছে।আর আমি বছর বছর শত শত মা বানাইয়া গেলাম!