আছি’ শব্দটির ভিতর এতো ভয়!

তমাল সাহা

তখন রাতের গভীর অন্ধকার, নাকি আমার মনের মধ্যেই অন্ধকার ঘনতম হতে থাকে! দুই অন্ধকার এক হয়ে গেলে কি রূপময় হয় তা আমি অনুভব করি।

বাবা লন্ঠন হাতে আমার দিকে ঝুঁকে গায়ে ঠেলা দিলো,জাগো। বাবা সাধারণত বলে, বেলা হয়ে যাচ্ছে ওঠো। কিন্তু আজ তো এখনো গভীর অন্ধকার! ওঠোর বদলে জাগো শব্দের ব্যবহার! এতো অন্ধকারের মধ্যে জাগতে হবে। বাবা বলে, অন্ধকারেই বেরিয়ে যেতে হবে চোরের মতো। পরাধীনতা থেকে মুক্তি মানে চোর হয়ে যাওয়া। পরাধীনতা থেকে মুক্তি মানে কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া। এও এক ধরনের কন্ঠরোধ।

বাইরে হট্টগোল শুনতে পাচ্ছো? শিব মন্দিরের পিলারটা ভেঙে পড়ল। পুজোর বাসনকোসন, ত্রিশূল, পঞ্চপ্রদীপ, শাঁখ মন্দিরের চাতালে ছড়ানো ছিটোনো। ঝুলন্ত পেতলের ঘন্টা খুলে নিয়ে গেছে কারা।

বাইরে আল্লা হো আকবর ধ্বনি। এর মানে জানো? ঈশ্বরই মঙ্গলময়। স্বাধীনতা মানে পরাধীনতা থেকে মুক্তি। সেটা দেখো কেমন মঙ্গলময়!

মকবুল চাচা বাড়ি ছুটে এলো। —কি করতাছেন মাস্টার বাবু? — চইল্যা জামু। চাচা জোর দিয়ে বলে, চইল্যা যাইবেন ক্যান? আমরা তো আছি। আছি শব্দের মধ্যে এতো ভয় লুকিয়ে থাকে,আমার মাস্টার বাবার চোখে তার একটা ছায়া দেখতে পেলুম।

আমরা ‘তৈরি হচ্ছি’। তৈরি হচ্ছি শব্দটা নতুন মাত্রা পেয়ে গেলো।‌পালিয়ে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি।আমি বলি, বাবা!রুবিয়া ফজলদের বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসব? শেষ দেখা!

বাবা বলে,না।জানাজানি হয়ে যাবে। পরে ঝামেলা বাড়বে। কত শব্দ শিখি নতুন তার মানে। স্বাধীনতার পরে জানাজানি, শেষ দেখা, ঝামেলা শব্দ তিনটি এতো ভীতিজনক হয়ে উঠল? হায় শব্দ!

বাবা বলে, মকবুল ভাই যাই। সব অপরাধ ক্ষমা কইরেন। এবার তার হাত দুটি ধরে বাবা আকুতির সুরে বলে, আমার এই যে লাইব্রেরীর ঘরটা, এর আলমারিতে কত বই! বাবার নামে এই লাইব্রেরী খুলছিলাম–অমর চাঁদ স্মৃতি পাঠাগার। আপনার কাছে শুধু অনুরোধ, এই বইগুলার যত্ন নিয়েন। দেখভালের দায়িত্ব আপনার হাতে দিয়া গেলাম।

মকবুল চাচা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।

বাবা বলে, ওপারের মানুষরাও তৈরি হচ্ছে। ‘এই তৈরি’ জীবন নিয়ে পালানোর দ্রুততম প্রস্তুতি। ওরা এপারে চলে আসছে। হিন্দু মুসলমান শব্দ দুটি এই মুহূর্তে ভীষণ জোরদার হয়ে উঠেছে। ওপারে মসজিদে ঢুকে কারা হামলা চালিয়েছে। উঠেছে জয় শ্রী রাম ধ্বনি। জয় তো আনন্দময় ধ্বনি। রাম মানে তো বিশালত্ব। শ্রী মানে তো সৌন্দর্য। স্বাধীনতা মানে দেশভাগ,পলায়ন। তাতে এতো আনন্দ! পলায়নে এতো বিশাল সৌন্দর্য! কে জানতো?

তখন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির চেয়ে প্রাণ ছিল বড়। জহরলাল নেহেরুর মধ্যরাত্রের বক্তৃতা শুনিনি। শুনিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে জাগরণের মহা মন্দ্রিত ধ্বনি। ভাষণ বা মন্দ্রকন্ঠ কি দেশের অখণ্ডতা ফিরিয়ে দিতে পারে? বুকে জমে থাকা ভয়কে দূর করে দিতে পারে? অনেক পরে এই দুই ঐতিহাসিক (!) বক্তব্য শুনেছি!

এই মহাসন্ধিক্ষণে বাবার কাছ থেকে , বাবার পাশে থেকে অনেক কিছু শিখেছি।

দেহজ রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও অতি নিকটজনের মৃত্যুর জন্য বাবার কাছে চোখের জল ফেলতে শিখেছি।

বাবা বলে, হাঁটো, তমু! মাইলস্ টু গো। পেছন ফিরে কিছুই দেখো না। মায়া বেড়ে যাবে। অন্ধকারের মধ্য দিয়েই পথ করে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটো। যত দ্রুত হাঁটবে ওদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবে আমাদের। ওরা দ্রুততম গতিতে চলে আসছে এপারে। আর আমরা দ্রুততম গতিতে চলে যাচ্ছি ওপারে। মুখোমুখি দেখা হবে এপার ওপার।

মানুষ মানুষের পাশে থাকবে তাতে এত ভয়! হায়, আল্লাহ! হায় ঈশ্বর!