সুকান্তর সঙ্গে কথা হলো…….

আজ আমাদের চেতনা জাগরণের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের মৃত্যুদিন কাঁচরাপাড়ায় তাঁর নামে সুকান্ত পাঠাগার ও কিশোর বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একদিন।
তাঁর উদ্দেশ্যে আজ অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ

সুকান্তর সঙ্গে কথা হলো
তমাল সাহা

ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে চাঁদের আলো। ‌ বৃষ্টিধারাগুলি স্পষ্ট দেখা যায়। সেদিন বৃষ্টিতে আকাশের চাঁদও বুঝি ভিজছিলো।
সুকান্ত সোজা ঢুকে পড়ল আমার ঘরে।
তো কি কারণে আমায় ডেকেছিলি? তো বল,কেন ডেকেছিলি?
জানো, এখন রাতে আমার ঘুম নেই। কী যে ছাড়পত্র লিখলে তুমি, অগ্নিকোণ লিখলে এসব এইসময়ে খুব মাথায় ঘোরে! তুমি কি শুনেছো যে,১২৪-এ ধারা অর্থাৎ রাষ্ট্রদ্রোহের আইন এই এই স্বাধীন ভারতবর্ষে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট মুলতুবি করে দিয়েছে?

তা এখন এসব আমায় বলে লাভ কি?
আমি বলি ওই বোধন কবিতাটি যদি তুমি এখন লিখতে,তাহলে এই কবিতাটি লেখার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারতে,এমন সম্ভাবনা ছিল। ‌তোমায় যদি গ্রেপ্তার করতো আমার একটু গর্ব হতো। তোমায় আমি অধিকন্তু লিখতে পারতাম, তুমি জেলখাটা কবি।

তা আসল কথা বল?
ওই খিদে রুটি চাঁদ তুমি মেলালে কি করে? তোমার স্নায়ুতে এটা কাজ করলো কি করে? ক্ষুধা আর গদ্য দুটো ভাবনা কেন একাকার হয়ে গেল তোমার মাথায়? গদ্যের বদলে পদ্য নয় না হলো, গদ্য না লিখে প্রবন্ধ লিখলে না কেন? এই চিত্রকল্প তো বিশ্ব কবিতায় আলোড়ন ফেলে দিয়েছে!
আমি কী আর অত জানি ছাই!। মাথায় এসে গেল লিখে দিলাম।
ওইটুকু বয়স, লোকে বলে কিশোর কবি! লেনিন গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথ হরতাল মিছিল সব,সব লিখলে! বোধন লিখে শেষ পর্যন্ত চলে গেলে প্রিয়তমাসুতে।

তাই কি ?
সিঁড়ি সিগারেট দেশলাই কাঠি ষাঁড় গাধা ছাগল কলম ভদ্রলোক– এসব তুচ্ছ জীবনরসদ। তা নিয়ে পর্যন্ত তুমি লেখো। অনেকে তো ব্যঙ্গ করেছিল তুমি যখন সোচ্চারে বলেছিলে, বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন। আর রানার! রানারকে নিয়ে গেলে অনাগত ভবিষ্যতের সংবাদের নিশানায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো সেই গান গেয়ে গেল কাঁচরাপাড়ায়। জানো, সলিল চৌধুরীও কতবার এসেছে এই জনপদে! ছন্দ ও আবৃত্তি নিয়ে তোমার লেখা বাচিকশিল্পীরা পড়ে?

আচ্ছা, তুমি তো গরিবের কথা অনেক লিখেছ। আমি তো ঘন ঘন শ্মশানে যাই। নটবর ঘাটে গিয়ে বসি। চিতাকাঠে আগুনের বিভিন্ন প্রকৃতি দেখি।
যত মানুষ পুড়ছে দেখি তারা কেউ খুব খেয়ে-পরে বেঁচে ছিল, আর না হয় মাঝারি তা যাই হোক মোটামুটি বেশ ভালোভাবেই তাদের দিন গুজরান হয়েছে। অতি ভালো না হলেও কিছু তো খেতে পরতে পারতো, তাদের শবদেহ দেখে বুঝতে পেরেছি!
আমি এখনও গরিব ভিখিরি, হাতপেতে খেতেচাওয়া কোনো মানুষকে পোড়াতে দেখিনি বা পুড়তে দেখিনি। দেখলেও আনুপাতিক হারে অনেক অনেক কম। বড়লোক খেতেপাওয়া লোক যত মরে না-খেতে পাওয়া লোক তত মরে না। এই বাস্তব দৃশ্যায়নে আমার তো তাই মনে হয়।

আরে! তোর পর্যবেক্ষণ তো ঠিকই আছে। গরিবের খিদে পায়, ওদের খিদে পেটে বেঁচে থাকে। খিদে পেলে বড়লোকেরা টাইম টু টাইম খেয়ে নেয়। ফলে তাদের খিদে মরে যায়। আর ওরা? ওদের তো খিদের জন্যই লড়াই। খিদে আছে মানে বাঁচার লড়াই বেঁচে আছে। তার মানে যাদের খিদে পায় সেই গরিবরা বেঁচে থাকে। ওরা মরলে লড়াইও মরে যাবে। তাই ওদের মৃতদেহ শ্মশানে তুই অত দেখতে পাস না। আর শোন, একটা জিনিস বারবার ব্যবহার করলে সহ্য হয়ে যায়। খিদে,খিদেটাও ওদের সহ্য হয়ে গেছে। ওদের একটা রুটি দিলেও ওরা খায়, দুটো রুটি দিলেও খায়। এটা ঠিকই কিন্তু খিদেটা ওরা জিইয়ে রাখে লড়াইয়ের জন্য। কারণ ওরা কোনদিনও পেটপুরে খেতে পায়না। তাই খিদেও মরে যায় না। তাই লড়াইয়ের জন্য ওরা বেঁচে থাকে। ওরা মরে না।

ভিখিরিদের বালবাচ্চারা কোনোমতে রাত কাটায়। ফুটপাতে দোকানের শেডের নিচে স্টেশনের চাতালে শুয়ে থাকে। তোদের ছেলেপুলেরা শুয়ে থাকলে এতদিনে ঠাণ্ডা সর্দিতে অসুখে বিসুখে মরে যেতো। ওদের ছেলেপুলেরা রোদ ঝড় জল বৃষ্টি উপেক্ষা করে ইস্পাতের পানদানের মতো পোড় খায়,লড়াকু হয়ে ওঠে,মরে না। ওদের খিদের জন্যই জীবন,জীবনের জন্যই খিদে। খিদে বেঁচে থাকে। কিছু বুঝলি?

আমি বিস্ময়ে সুকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।

সুকান্ত আমি যেন সেই বাতিওয়ালা ঘুম ভাঙানোর গান গাইতে গাইতে দিগন্তে প্রত্যাসন্ন ঝড়ের ছবি এঁকে
আমার দিকে পিছন ফিরে হাঁটতে থাকে…..