সরলবর্গীয় বৃক্ষের সন্ধানে/তমাল সাহা

বিশ্বের চলমান ময়দানে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের জন্ম শতবর্ষে শ্রদ্ধায় ও স্মরণেঃঅবতকের বিশেষ প্রতিবেদন

সরলবর্গীয় বৃক্ষের সন্ধানে
তমাল সাহা

এইভাবে একটি মানুষ দাঁড়িয়ে গেল আর্জব বিভঙ্গে। জনারণ্যে তখন সরলবর্গীয় বৃক্ষের বিরল দৃশ্যমানতা। আকাশ কুসুম, বাইশে শ্রাবণ অনেক তো হলো নীল আকাশের নীচে! কী দেখলে তুমি আর আমরাই বা কী দেখলাম?

খরতপ্ত রৌদ্র দাবদাহ। সূর্যও নিজেকে পোড়ায়। সূর্য তখন অনেক দূরে তবুও দুরন্ত সব ছায়া পড়ে গাঁয়ে-গঞ্জে গোপন নির্জনে কোন পোড়ো বাড়িতে বা আজ পাড়ার সবজি বাগানের আড়ালে। শহুরে চায়ের আড্ডায় অনেক লাল সুতোর বিড়ি পুড়ে যায় দু ঠোঁটের মাঝখানে, ধোঁয়াগুলি কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরে ঘুরে উড়তে থাকে। বিড়ির টানের তীব্রতায় দুই একটি অগ্নিকণাও এদিক ওদিক ছিটকে পড়ে। ছায়ারা সব দুরন্ত হতে থাকে রাজধানী কলকাতার অ্যাসফল্ট ঢালা রাস্তায়।

একটি মানুষ চৈতন্য ফিরিয়ে দেয়। চলচ্চিত্রে বা সিনেমায় চলমান চিত্রভাষ্য অথবা ভাষ্যচিত্র হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র, শাসনব্যবস্থা, শাসকের মাতব্বরি নির্মাণ শৈলীর তির্যকে ব্যাঙ্গে বিদ্রুপে উত্তেজনায় ভেঙে পড়ে,ভেঙে পড়ে দুর্ধর্ষ বিক্রমে আধারে সুরক্ষিত বাণিজ্যিক ম্যানিকিন‌। তুমি সেই ব্যক্তিত্ব সময়ের ধারাবিবরণী লিখে জবাবদিহি চাও। রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা থাকলেও তুমি চেতনায় বয়ে আনো অন্য অভিঘাত। কেন ভাঙনপর্ব অনিবার্য আঙুল দিয়ে দেখাও ও নির্দেশ করো। তাহলে সত্তর দশকের অবশ্যম্ভাবী সশস্ত্র অভিযানের মূলেও লুকিয়ে ছিল তোমার অস্ত্রবান চলচ্চিত্র, তা বললে কী কোনো অত্যুক্তি হয়?
কিসের ইন্টারভিউ, কাকে ইন্টারভিউ,কেন ইন্টারভিউ– তার তো তুমিই সূচনা করেছিলে।
বায়োস্কোপ যখন সিনেমা হয়ে ওঠে তখনই তো সে হবে ঘুম ভাঙার এবং ঘুম ভাঙানোর চলচ্চিত্র।

wall মানে দেয়ালের প্রয়োজন, হাতে চুনকামের ঝোপড়া ও মালসায় ভুষোকালির আয়োজন, জরুরি প্রয়োজন স্লোগানের, প্রয়োজন অলিগলি ময়দান, প্রয়োজন তারুণ্যের দৌরাত্ম্য, প্রয়োজন মিছিল সমাবেশের এবং লাল পতাকার– এসব তুমি জানিয়েছিলে আমাকে। কেন ভোট শব্দের পর প্রশ্নবোধক চিহ্ন, কেন বিস্ময়কর চিহ্ন বসিয়েছিলে তুমি? কেন! কেন!

মেট্রো সিনেমা হল‌। কলকাতা ৭১। ম্যাটিনি প্রথম শো দেখার পর বাইরে বেরিয়ে শত শত জনসমূহের মধ্যে তুমি! দেখি সিনেমা বানানেওয়ালাকে ঘিরে ভিড়! সিনেমা বাংলায় বই হয়ে গেলে তার দুরন্ত পাঠ ভীষণ জরুরি হয়ে পড়ে। আমি দ্বিতীয়বার ছবিটি দেখি নৈহাটীতে। সিনেমা হলের
দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ি অন্ধকারের গভীরে। তুমি তো জানতেই বজ্রনির্ঘোষ হবে। তার আগাম প্রস্তুতিপর্বের কথা আমি জানি। তার উপাদান উপকরণ অনুষঙ্গ মানুষের মিছিল মিটিং দাবি সংগ্রাম সমাবেশের ছবি তুমি বন্দী করছিলে ক্যামেরায়। ক্যামেরার উজ্জ্বল চোখের তারার লেন্সের মধ্য দিয়ে এইসব বারুদবাহী আগ্নেয় রসদ ঠেসে ভরছিলে। কলকাতা একাত্তরে তুমি আমাদের কী দিয়েছিলে? যুবকটি যখন গুলি খেয়ে পড়ে গেল সে কী নিহত হলো? না, সময় নিহত হয় না। তারপর এই ভৌগোলিক বারান্দায় একের পর এক ইতিহাস নির্মাণ হতে থাকলো।

পদাতিক আর পরিব্রাজকের মধ্যে পার্থক্য কোথায় তা তুমি আমাকে জানালে? পরিব্রাজকের মধ্যে থাকে পরিব্রজনের মাধুকরী– এসব শুনতে ভালো‌ আসলে পদাতিক হওয়াটাই জরুরি। পূর্বজ পুরানো হয়ে গেলেও বুড়ো হয় না, হয় বৃদ্ধ-জ্ঞানী। সে প্রজন্মের পিঠে হাত রাখে। মুখোমুখি হয়ে বলে মানুষের ইতিহাস অগ্রগমনের ইতিহাস– চরৈবেতি।

জীবন কাঁটাতারে ঘেরা হতে পারে তাকে কী সত্যিই ফ্যান্টাসি বলে চালানো যায়? নেগেটিভ না তুললে কখনো কি পজিটিভ ছবি হয়- আলোর উদ্ভাসেই আসল মুখ শনাক্ত করা যায়।
ক্যামেরার কারিগরিতে ছবি জুম করা যায়, লং শট জাম্প শট কত নির্মাণ-বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে তুমি আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতায় গড়ে তোল। সমাজ থেকে কী মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায়? কত বার দন্ত্য-স মিললে জীবন তৈরি হয়? সংস্কৃতি, সংগ্রাম, সম্মিলিত স্বর মেলবন্ধনে হয়ে ওঠে জীবন। জীবন মানেই তো সেই সমন্বয়ের উজ্জ্বল নির্মাণ‌– কোরাস।
আকালের সন্ধানে তুমি ক্যামেরার চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়াও। দৈন্যবাহী এই দুঃসময়ে চিন্তা মননের চরম আকালে আমাদের খণ্ডহর জীবনের এই পাহাড়ি বন্ধুর পথে একটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সরলবর্গীয় বৃক্ষের মতো আরেকটি তোমার সন্ধানে উদগ্রীব হয়ে আছি।