শ্যামনগর ওয়েভারলি মিল বন্ধ হয়ে গেল। তিন হাজার শ্রমিকের নোকরি খতম। রাষ্ট্র নীরব, নেতারা নিঃশ্চুপ

শ্রমিকের গান
তমাল সাহা

শ্রমিক শব্দটি আমি তো বহুদিন ভুলিয়া গিয়াছি।

শ্রমিকের শৃঙ্খল ছাড়া হারাইবার কিছু নাই। জয় করিবার জন্য রহিয়াছে সমগ্র দুনিয়া। ‌
এইসব কথা কি এখন মনে পড়ে আর?
কতবার ঘুরিয়াছি হুগলি নদীর পার।

কত রকম শ্রমিক দেখিয়াছি চোখে। ‌
দুর্জয় চোখমুখ, তাহাদের কে রোখে?
এইসব স্মৃতি ধূসর হয়ে যায়।
আমি কি লিখি,কি আঁকিবুকি করি খাতার পাতায়।

শ্যামনগর ওয়েভারলি জুটমিল বন্ধ হয়ে যায়,ক্ষতি হয় কার?
তিন হাজার শ্রমিকের ভুখাপেট হয়ে যায় বেকার।

সেই হুগলি নদীতীর
আমি আসিয়াছি ঘুরে বহুদিন পর।
এখানে ছিল শ্রমিক মহল্লা,
শত শত বস্তির ঘর।
কতসব শ্রমিকের নাম শুনিয়াছি—ভাগওয়ালা, বদলি।
কত মজুরি তাহাদের তাহাও
শুনিয়াছি আমি।
কপালে করিয়াছি চপেটাঘাত,হায়!
এই আমার দেশ, এই আমার জন্মভূমি।

আমি শ্রমিক শব্দের প্রতিশব্দ জানি—
মজুর, শ্রমজীবী, মেহনতি,শ্রমিষ্ঠজন,কামগার।
এতো শব্দ জানি,
তবু কোথাও দেখিতে পাই নাই দানাপানি,
তাহাদের পেটের খাবার।

ব্যঞ্জনা খুঁজিয়া পাই মজদুর শব্দটির ভিতর—
পেশীবহুল হাত, কব্জির জোর, হাতে হাতুড়ি।
তাহাতে কি আর এমন বাহাদুরি!

একের পর এক শেডে জং ধরে,
চিমনি কাত হয়ে পড়ে। আগুনের হল্কা
ওঠে না আর চুল্লীর পেটে।
অতিকায় মালিকের শাসানির চোটে
তালা পড়ে চটকল গেটে।

বাংলা লিখিতে লিখিতে আমি ইংরাজি শিখিয়া যাই।
যদিও কোনোদিন পুলকার চড়ি নাই।
পিঠে ভারি ব্যাগ, হাতে জলের বোতল— ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ি নাই।

কেমন করিয়া শিখিয়া গিয়াছি আমি তো জানিনা শব্দদুটি— ক্লোজার ও লকআউট। আসলে তিনটি শব্দ শিখিয়াছি আমি, তৃতীয়টির মানেই আসল—
রে মজদুর! তুই গেট আউট।

কি করিব এখন আমি? আরো শুদ্ধ ইংরাজি শিখি— সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক। শ্যামনগর ওয়েভারলি জুটমিলে ঘুরিয়া আসি।
তিন হাজার কামাগারের চোখে নেমে আসে অন্ধ রাত্রি,নাইট অফ ডার্ক।

জ্ঞানের বহর ক্রমাগত বাড়িতেছে আমার, বড় আনন্দ পাই।
ভোরে ভীমসেন যোশীর ভৈরব শুনি, সান্ধ্যকালে বিসমিল্লার সানাই।

শ্রমিকের বড় দোষ—
অশিক্ষিত, শালারা হারামি।‌
অতিকায় মালিক মারিয়া দিয়াছে
পিএফ-এর ১৭ কোটি,৩ কোটি গ্র্যাচুয়িটি।
চুপ করে যা, অসহিষ্ণু হোস কেন,
লড়াইয়ে কেন নামিস— পথ তো অগ্নিগামী।
মালিক শোষণ করবে বলে
তুইও করবি ভাঙচুর, গাড়িতে দিবি আগুন!
এত দুঃসাহস, আস্পর্ধা তোর!
হয়ে যাবি খুন।

ওদের রাষ্ট্র আছে,
আছে পুলিশ, বুলেট, বন্দুক।
তোর কি আছে,
শুধু সোচ্চার কণ্ঠ, চেতানো বুক।
সেই বুক যদি হয় চাঁদমারি,
পড়িয়া থাকিবে লাশ।
বিধবা হইবে স্ত্রী, মা হইবে পুত্রহারা
সন্তান-সন্ততি জলে ভাসে আঁখি,
তোকে ঘিরিয়া দিবে পাহারা।

তারপর!তারপর! কি হইবে পরিণাম?
পরিবার বসিবে পথে—
এবার নামিয়া আসিবে চোখের নিকট
অন্ধ ত্রিযাম।