আজ মহান কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১২৫তম জন্মদিবসঃ
অবতকের বিশেষ প্রতিবেদন

লাল মাটির দেশের লেখক রে!
তমাল সাহা

২৩ জুলাই,১৮৯৮।বাংলার অন্যতম সাহিত্যিক তারাশঙ্করের জন্মদিন। বাংলা সাহিত্যে যে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলা হয়েছে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়– এঁরা হলেন সেই ত্রয়ী। প্রত্যেকেই সাহিত্য রচনায় এক এক দিক উন্মোচন করেছিলেন। এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায়কেই কথাশিল্পী বলা হয় মানে জীবন কথাশিল্পী। তাঁরা মানুষের জীবনের কথা লিখে গিয়েছেন।
আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ, অন্ত্যজ মানুষ, দলিত মানুষের কথা। আর এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে কাঁচরাপাড়ার জনজীবন জড়িত।

কাঁচরাপাড়া বোর্ডের মুরাতিপুর গ্রামে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মেছিলেন। এখন তা কল্যাণীর অন্তর্গত। তিনি ‘খুঁটির দেবতা’ গল্পে কাঁচরাপাড়া কারখানা ও তার সাইরেন ধ্বনির কথা উল্লেখ করে গেছেন।
মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রগতি পাঠাগারের আয়োজনে চীন-ভারত মৈত্রী বিষয়ক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে কাঁচরাপাড়া জ্ঞানমুকুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পদার্পণ করেছেন, সেটা ১৯৫৫ সাল। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও কাঁচরাপাড়ায় এসেছেন।

আচ্ছা বলি, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। তাঁকে তমু দেখেছিল কোনোদিন প্রাণভরে। তাঁর কথা যাকে তোমরা বলো ভাষণ তাও সে শুনেছিল। কে যেন বলেছিল, হায়! জীবন এত ছোট কেনে? আর কি বলেছিল? কালো যদি মন্দ ,তবে চুল পাকিলে কান্দ কেনে? তাঁর এইসব সাহিত্যের লাইন আজ প্রবাদ প্রতিম।

১৯৬৩ সাল। তখন তমু ক্লাস এইটে পড়তো। কাঁচরাপাড়া হাই স্কুলে। তমুদের বাংলার মাস্টারমশাই ছিলেন অমিয়বাবু। অমিয়ভূষণ সরকার। ছোটবেলা থেকেই তমুর একটু লেখার দিকে ঝোঁক। তখন একটু গ্রামীণ নস্টালজিক এইসব ধারায় তমু লিখতো এবং সেসব লেখা বাংলার মাস্টারমশাইকে দেখাতো। তাই তিনি তমুকে সেদিন ক্লাসে বললেন, তুই কি যাবি?তমু বললো, কোথায় স্যার?
অমিয় বাবু বলেন, চব্বিশ পরগণা জেলা সাহিত্য সম্মেলনে। তখন কি আর এতো তমু বুঝতো? সাহিত্য! তার আবার সম্মেলন! তাও কিনা সেটা হবে কাঁচরাপাড়ায়! বেল ইনস্টিটিউটে!

২৩ মার্চ সেই সম্মেলনে তমু গিয়েছিল। তমু তাঁকে মানে তারাশঙ্করকে খুব কাছ থেকে দেখেছিল। আর মনে পড়ে গিয়েছিল তাঁর লেখা একটি লাইন– তোমার রাজকাছারির দেউরিতে হে বসে আছি।
তমুদের বাংলার স্যার সেই সম্মেলনের ছিলেন সাহিত্য সম্পাদক। আর সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সঞ্জীবকুমার বসু।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন তারাশঙ্কর আধুনিক সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনা করলেন। সম্মেলন চলেছিল তিন দিন।২৩,২৪,২৫ মার্চ,১৯৬৩।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়— যিনি তারা তিনিই শঙ্কর। প্রকৃতি ও পুরুষের এক অদ্বয় মিলন। এই মানুষটি ফ্যাসি বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে জড়িয়ে পড়েন। আমাদের চোখে বিস্ময়! এই মানুষটি ‘গণদেবতা’ আর ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ লেখেন!

১৯৫৭ সাল। তাসখন্দে এশিয় লেখক সম্মেলনে তিনি গিয়েছিলেন। আর পুরস্কার! শরৎ-জগত্তারিণী-রবীন্দ্র- সাহিত্যএ্যাকাডেমি-জ্ঞানপীঠ– এসব কোনো ব্যাপারই নয়। মুড়ি মুড়কির মতো অর্জন করেছিলেন তিনি এসব পুরস্কার।

সেই মানুষটি আবার এসেছিলেন তমুদের হালিসহরে। রামপ্রসাদের ভিটেতে। ২৮ এপ্রিল ১৯৬৮। মোহিতলাল মজুমদারের আশিতম জন্মদিনে। শরৎ সাহিত্য সংসদ ও হালিসহর নাট্য সংস্থা ছিল আয়োজক। তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গ ছিল মোহিতলালের সাহিত্য কীর্তি। আর শরৎ সাহিত্য সংসদ মানে শিক্ষক-সাংবাদিক গৌরীপদ গাঙ্গুলি, তাঁর কথা কে না জানে!

সেই সময়ে বীজপুরে অন্যতম সাহিত্যিক কাঁচরাপাড়াবাসী জগদীশ মোদক। তখন তমুদের অঞ্চলে জগদীশদার খুব নামডাক। জগদীশদার ব্যক্তিগত সখ্য ছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে। তিনি তাঁর টালাপার্কের বাড়িতে বহুবার গিয়েছেন। একসঙ্গে আহারপর্ব সেরেছেন। একথা তিনি তমুকে বলেছেন বিভিন্ন আলোচনায়। জগদীশদা তমুকে খুবই ভালবাসতেন। এইভাবে কাঁচরাপাড়ার সঙ্গে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা যোগসূত্র রচিত হয়ে গিয়েছিল।

তাহলে সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে আরেকটু ডিটেইলে বলি। ‘সংস্কৃতি’ নামে যে সাহিত্য পত্রিকাটি সঞ্জীবকুমার বসু সম্পাদনা করতেন সেটির দ্বিতীয় সঙ্কলনটি ২৪ পরগণা জেলা সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যারূপে আত্মপ্রকাশ করে।

উল্লেখ্য এই সম্মেলনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন। সভাপতি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী রায় হরেন্দ্রনাথ চৌধুরী। উপদেষ্টা সমিতির সভানেত্রী ছিলেন লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়। কার্যকরী সভাপতি ছিলেন অশোককৃষ্ণ দত্ত। সহ সভাপতি ছিলেন হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ফণীন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সঞ্জীব কুমার বসু। সম্পাদক ছিলেন অতুল্যচরণ দে পুরাণরত্ন।পৃষ্ঠপোষক ছিলেন অতুল্য ঘোষ, জগন্নাথ কোলে, তরুণকান্তি ঘোষ, অর্ধেন্দু শেখর নস্কর, জিয়াউল হক, অশোক কুমার সরকার, কেদারনাথ মুখোপাধ্যায় ও নরেশনাথ মুখোপাধ্যায়। উপদেষ্টা মন্ডলীতে ছিলেন সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, হুমায়ুন কবীর, প্রমথনাথ বিশী, প্রবোধকুমার সান্যাল, বিনোদ বিহারী দত্ত, পরেশ চন্দ্র দাশগুপ্ত, কালিদাস দত্ত, ভবানী মুখোপাধ্যায়, পঞ্চানন ঘোষাল জেলাশাসক চব্বিশ পরগণা পদাধিকার বলে, এবং পুলিশ সুপার চব্বিশ পরগণা পদাধিকার বলে।

এটি ছিল একটি বড় মাত্রার সাহিত্য সম্মেলন। এই ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন “সাহিত্যের নবরাগিণী” নামের একটি প্রবন্ধ। আমাদের মাস্টার মশাই অমিয়বাবু লিখেছিলেন ‘২৪ পরগণা জেলার মনীষী’, বিনয় ঘোষ লিখেছিলেন ‘২৪ পরগণার লোকসংস্কৃতি প্রসঙ্গে’, লিখেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন বসু প্রমুখ।আর উপস্থিত ছিলেন রেল ওয়ার্কশপের ওয়েলফেয়ার অফিসার ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’ খ্যাত ও রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিক সুবোধ চক্রবর্তী।
এটির প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন কাঁচরাপাড়ারই এক চিত্রশিল্পী পুষ্প ঘটক।

২৩ মার্চ১৯৬৩ এই সম্মেলন উপলক্ষে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন লেডি রাণী মুখার্জি। সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী রায় হরেন্দ্রনাথ চৌধুরী।

নক্ষত্রখচিত এই সমাবেশ ও সাহিত্য সম্মেলন কাঁচরাপাড়ার বুকে এক অনন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস। এতো মনীষা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে এক সঙ্গে দেখার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা তমুর জীবনে আর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্র তৈরির এক রুপোলি রেখা সুনিশ্চিতভাবে।