রবীন্দ্রনাথ ও কাঁচরাপাড়া/তমাল সাহা

আজ পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন।

অবতকের বিশেষ প্রতিবেদন

রবীন্দ্রনাথ ও কাঁচরাপাড়া
তমাল সাহা

রবীন্দ্রনাথ! রবীন্দ্রনাথ! রবীন্দ্রনাথ! আমাদের রবীন্দ্রনাথ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের উঠোনে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, আন্তর্জাতিক তাঁর খ্যাতি। এই মানুষটির জীবন ব্যারাকপুর মহকুমার সঙ্গে নিশ্চিত জড়িয়ে গিয়েছিল। পলতা,খড়দহ, পানিহাটি, বরানগর,মূলাজোড়,নিমতা,গরিফা এইসমস্ত অঞ্চলে তিনি এসেছিলেন। এই মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চল তাঁর স্মৃতিবিজড়িত হয়ে আছে।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নেতৃত্বে চতুর্দশ বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৩৩০ সালের ৮ ও ৯ আষাঢ়। ৮ আষাঢ় সম্মেলনের প্রথম দিন নৈহাটীতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,’নব্য বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যত, বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতির উদ্দেশ্যে অর্ঘ‍্য দিতে নৈহাটি সম্মেলনে আসিয়াছি।’ এটি একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে শৈশব থেকেই রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ‍্য।

রবীন্দ্রনাথ কাঁচরাপাড়ায় আসেননি। কিন্তু কাঁচরাপাড়ার সঙ্গেও তাঁর জনজীবন যুক্ত হয়ে গিয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ কাঁচরাপাড়া শব্দটি লিখতেন, আমরা যেমন লিখি কাঁ চ রা পা ড়া। তিনি সেই জায়গায় ‘র’-এর জায়গায় ‘ড়’ লিখতেন ‘কাঁচড়াপাড়া’। তাঁর বানানটি ছিল আমাদের বর্তমান বানানের চেয়েও আলাদা। কাঁচরাপাড়া স্হানটি নিশ্চিতভাবে রবীন্দ্রনাথের স্মরণে ছিল। কাঁচরাপাড়া নিয়ে তিনি নিশ্চিত ভাবতেন। কাঁচরাপাড়া নিয়ে তাঁর লেখা দুটি কবিতা ‘খাপছাড়ায়’ প্রকাশিত হয়।
একটি কবিতা : কাঁচরাপাড়াতে এক/ ছিল রাজপুত্তুর, /রাজকন্যারে লিখে /পায় না সে
উত্তর।/টিকিটের দাম দিয়ে/ রাজ্য বিকাবে কি এ,/ রেগেমেগে শেষকালে/বলে ওঠে– দুত্তোর!/ ডাক বাবুটিকে দিল মুখে ডালকুত্তোর।’
দ্বিতীয় ছড়াটি তিনি লিখেছিলেন,
‘বাংলাদেশের মানুষ হয়ে/ ছুটিতে ধাও চিতোরে,/ কাঁচরাপাড়ার জল হাওয়াটা/ লাগল এতই তিতো রে!/মরিস ভয়ে ঘরের প্রিয়ার,/পালাস ভয়ে ম্যালেরিয়ার,/হায় সে ভীরু, রাজপুতানার/ ভূত পেয়েছে কু তোরে।/লড়াই ভালোবাসিস, সেতো /আছেই ঘরের ভিতরে।’

কাঁচরাপাড়ার সঙ্গে আরও জড়িয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বভারতীর সংগ্ৰহশালায় রয়েছে কাঁচরাপাড়ার ‘কয়লার কারিগর’ সেই প্রখ্যাত সত্যরঞ্জন দাশগুপ্তের পাথুরে কয়লার রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতির ভাস্কর্য। রবীন্দ্রভারতীতে রয়েছে কাঁচরাপাড়ার সেই প্রখ্যাত ঘুরবাজ গোষ্ঠবিহারী দে-র রবীন্দ্রনাথের উপরে দেশ-বিদেশের ডাকটিকিটের সংগ্ৰহ। ২২শে শ্রাবণ,১৪০৫ গোষ্ঠ বাবু এটি জোড়াসাঁকোয় ঠাকুরবাড়িতে উপাচার্য শুভঙ্কর চক্রবর্তীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। উপস্থিত ছিলেন প্রতাপ চন্দ্র চন্দ ও শান্তিদেব ঘোষ।
আরো কথা আছে রবীন্দ্রনাথ কী কাঁচরাপাড়া ছাড়া বাঁচে? এই শহরতলিতে এক মানুষ ছিলেন। তিনি ছবি আঁকেন, মূর্তি বানান। তিনি তানসেন ঘরনার শিল্পী। সেতার বাদনে তাঁর নৈপুণ্য রয়েছে। তিনি একটি পোস্ট কার্ডে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মেজদিদি’ উপন্যাসের পঞ্চম অধ্যায় সম্পূর্ণ তো লিখেছেনই সঙ্গে ষষ্ঠ অধ্যায়ের প্রথম অনুচ্ছেদ সংযোজন করে লিখনশৈলীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ১৯৫৫ সালে এই অসামান্য কাজটি তিনি করেছেন এবং তা সসম্মানে কলকাতা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এই মানুষটির নাম ভোলানাথ রায় চৌধুরী। তিনি কাজ করতেন রেল ওয়ার্কশপে ৭ নম্বর লোকো শপে টুল রুমে। তিনি থাকতেন সেই কাঁপা অঞ্চলে মথুরা বিল ধারে।

তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এক কর্মকান্ড করে বসলেন! রবীন্দ্রনাথ রেলের যে সেলুন কার চড়ে বিশ্বভারতী থেকে কলকাতা এসেছিলেন তা প্রদর্শনযোগ্য ইতিহাস হয়ে গেছে। ১৯৮৬ সালে সেই সেলুন কারটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয় রেল কর্তৃপক্ষ। সেই সেলুন কারের আর্ট গ্যালারিতে গমের বিচালি দিয়ে তাঁর অপূর্ব নির্মাণ রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। তার এই কর্মশৈলীর জন্য পূর্ব রেল ম্যানেজার ঋষিকেশ বন্দ্যোপাধ্যায় শংসাপত্র, ৫০০ টাকা এবং একটি সঞ্চয়িতা পুরস্কার হিসেবে তাঁর হাতে তুলে দেনৃ তাঁর আরেকটি অঙ্কন নৈপুণ্য মার্বেলিংয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি বোলপুর রেলস্টেশনের আর্ট গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে।
এই সেলুন কারটি সে সময়ে বারাকপুর রেল স্টেশনে এবং কল্যাণী রেলস্টেশনে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছিল।
কাঁচরাপাড়া স্বচক্ষে রবীন্দ্রনাথকে না দেখুক রবীন্দ্রনাথকে পথ চলতে চলতে স্মরণে রাখবার জন্য কাঁচরাপাড়া স্টেশন থেকে বাগমোড় পর্যন্ত রাস্তারটির নাম করে দিয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রপথ। শ্রী লক্ষ্মী সিনেমার বিপরীতে তার নামাঙ্কিত রাস্তার পাশেই প্রতিষ্ঠা করেছে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি। সাধারণ মানুষও তাকে খুব ভালবাসে। লিচু বাগান অঞ্চলে লিটিল স্টার ক্লাবটি তাদের দপ্তর কক্ষে প্রবেশ পথের পাশে রবীন্দ্রনাথের একটি পূর্ণ ভাস্কর্য স্থাপন করেছে। এসবই কাঁচরাপাড়া যে রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসে তার কথা। ‌ তাহলে? রবীন্দ্রনাথ কী কাঁচরাপাড়া ছাড়া বাঁচে!