অবতক খবর,রূপম রায়,২৭ অক্টোবর: দেখে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না! একবার কেন, হাজার বার দেখলেও কোনও সংশয় তৈরি হচ্ছে না মনে। চোখেও ধরা পড়ছে না কোনরকম তারতম্য। শিল্পীর এত সূক্ষ্ম কারুকার্য। বার বার চোখ চলে যায় দেবীমূর্তির নয়ন যুগলে। শিল্পী যে কত পরম যত্নে চক্ষুদান করেছেন,তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। দেবীমূর্তিই তো!

পেশায় মেকআপ আর্টিস্ট সোদপুরের মুক্তি রায়। তাঁর হাতেই সম্ভব হয়েছে এই অসম্ভব। নিপুণ হাতে মূর্তির আদল ফুটিয়ে তুলেছেন মানব শরীরে। আর মুক্তির একের পর এক চালে সমান ধৈর্যে ‘দেবী-সম মূর্তি’ হিসাবে নিজেকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন মডেল রিখিয়া রায়চৌধুরী। দমদমের কন্যা নিজেকে ‘বড়মা’ গড়ে তুলতে সময় দিয়েছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর মুক্তির এই অসাধারণ কারুকার্যের শেষে সেখানে উপস্থিত সকলে দু হাত জোর করে প্রণাম করেছেন বড়মাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে তাদের চোখের সামনেই রিখিয়াকে মায়ের রূপ দান করা হয়েছে। কিন্তু পরিশেষে তাকে রিখিয়া হিসেবে নয়, বরং যেন জীবন্ত বড়মাকে দেখেছেন সকলে।

উত্তর ২৪ পরগণার নৈহাটির অরবিন্দ রোডে আয়োজিত হয় জনপ্রিয় ‘বড় মা’ কালীর পুজো। গত ১০০ বছর ধরে এই পুজো চলে আসছে। প্রথমে এটি বাড়ির পুজো হলেও পরবর্তীতে এটি সর্বজনীনের চেহারা নেয়। এই পুজোর ২২ ফুট অর্থাৎ ১৪ হাত দীর্ঘ প্রতিমার জনপ্রিয়তা দেশে-বিদেশে। সেই প্রতিমার আদলেই রিখিয়াকে সাজিয়েছেন মুক্তি। তাঁর কথায়, ‘‘বছর দশেক আগে প্রথম বার নৈহাটির বড় মায়ের পুজোয় যাই। ওই বিশাল মূর্তি আর তার ভাব দেখে আমার গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। চোখে চলে এসেছিল জলও। সেই মায়ের রূপ ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম। প্রথমে ভয় করছিল। দ্বিধাও কাজ করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করে ফেললাম।’’

যাঁর শরীরে প্রতিমার আদল আঁকলেন শিল্পী, সেই রিখিয়া বলেন, ‘‘আমরা জানতাম এই ছবি ভাইরাল হবে। কিন্তু এত হবে, তা বুঝতে পারিনি। আমি প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা সে দিন চোখ বুজে ছিলাম। চোখের উপর আঁকা শুরুর সময় থেকে ছবি তোলার সময় পর্যন্ত, দেখতে পাইনি তেমন। তবে কী জানি, শরীরে কী একটা অদম্য জেদ যেন ভর করেছিল। ক্লান্তি ছিল না। বড় মা মানে একটা আবেগের জায়গা। সেটা কোনও ভাবে আহত হলে আমাদের সমালোচনা করা হত, তাই সতর্ক ছিলাম। আজ তার ফল পাচ্ছি।’’

রিখিয়া রূপটানের সময় শুধু দাঁড়িয়ে থেকেছেন তাই নয়, চোখ বন্ধ করে ছবি তুলিয়েছেন টানা ৪-৫ ঘণ্টা। সেই ছবিই এখন ভাইরাল। তবে মুক্তি ও রিখিয়ার দাবি, জনতার এমন সাড়া তাঁরাও আশা করেননি। তাঁদের মনে হয়েছিল, কালীপুজোর কয়েক দিন আগে এই ছবি মুক্তি পেলে মানুষ হয়তো সাধুবাদ দেবেন, কিন্তু তা পরিণত হয়েছে উচ্ছ্বাসে। মুক্তির কথায়, ‘‘এতটা আশাই করিনি। রূপটানের জন্য সময় লেগেছে প্রায় ৯ ঘণ্টা। কাজ করেছেন ছ’জন। কেশসজ্জা শিল্পী স্বরূপ দাশ, চিত্রগ্রাহক অমিত চক্রবর্তীরাও টানা কাজ করেছেন সেই দিন। আমি দীর্ঘ দিন ধরেই সৃজনশীল রূপটান শিল্প নিয়ে কাজ করছি। এর আগেও চোখের উপর এঁকে কাজ করেছি। কিন্তু তার বেশির ভাগই বিভিন্ন প্রাণীর আদলে। এ বার একেবারেই অন্য রকম কাজ ছিল। ভেবেই নিয়েছিলাম এমন করে সাজাব, যাতে মানুষ ছবি ভেবেই প্রণাম করে। শেষ পর্যন্ত তাই হল।’’ ফেসবুকে প্রতি মুহূর্তে মন্তব্য বাক্সে সাধুবাদ জানিয়ে যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে ‘অবিশ্বাস্য’, ‘দারুণ’, ‘নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না’-র মতো এক একটি আবেগ-বাক্য। মুক্তি বা রিখিয়ার বাইরে, যাঁরা কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যায় দেবী পুজো করেন ভক্তি ভরে, তাঁরাও অবাক।

যে মূর্তির আদলে মুক্তি রিখায়াকে নির্মাণ করেছেন, নৈহাটির সেই ‘বড় কালী পুজো সমিতি’র সম্পাদক তাপস ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘ছবি দেখে মনে হচ্ছে, মা যেন জ্যান্ত হয়ে গিয়েছেন। আমাদের মা এমনিতেই জাগ্রত, তিনি কথা শুনতে পান। অসম্ভব সুন্দর হয়েছে সবটা। আমাদের পুজোয় মায়ের মাটির মূর্তিতে থাকে সোনা ও রুপোর গয়না। সব মিলিয়ে জাগ্রত দেবীকে দেখেই গায়ে কাঁটা দেয়। ঠিক যেন তেমনই হয়েছে এই ফোটোশ্যুট। অবিকল মায়ের মূর্তি দেখছি মনে হচ্ছে। শিল্পীদের আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই। পুজোর ঠিক কয়েক দিন আগে এই ছবি যেন একটি উপহার।’’