গান্ধীমোড় ছাড়িয়ে কবিগুরু রবীন্দ্র পথের দুপাশে সরস্বতী মূর্তি নিয়ে বসে আছে পটুয়ারা। এখন সেই পটুয়াদের কথা শুনুন।

মা-কে বেচে খাই
তমাল সাহা

মহাদেব বসে আছে রবীন্দ্রপথে—
কবিগুরু রবীন্দ্র পথ, কাঁচরাপাড়া।
গান্ধীমোড় ছাড়িয়ে একটু দূরে
দুদিকে ফুটপাথ।
আশ্রয় নিয়েছে সেখানে আজ
মহাদেবের পরিবার।

মহাদেব পাল। চৈতন্য ডোবা থাকে। পটুয়া।
তার চারজনের সংসার। রামকৃষ্ণের মতো তার চেহারা। মুখ ভর্তি দাড়ি। রামকৃষ্ণের মতো পরিধেয়। গায়ে একটা ফতুয়া।

প্রতিমা শিল্পী মহাদেব পাল।
পঞ্চাশটি সরস্বতীর মূর্তি বানিয়েছে।
পাঁচটি বড় সরস্বতী—
খুব বড়ও নয়, মাঝারি সাইজের।
আর পঁয়তাল্লিশটি ছোট সরস্বতী।
বিদ্যার যেমন কমবেশি আছে,
অর্থাৎ ছোট বড় আছে, তেমন
সরস্বতীরও ছোট বড় আছে।

মহাদেব বলে, এখন আর পারিনে,ভাই।
শরীরটারও তেমন জুত নেই। পুঁজিপাট্টারও জোর নেই। শীতে বড্ড কাহিল হয়ে পড়ি।
এই আমার বউ পার্বতী।পিতিমে বানাতে এখন মেয়েদেরও হাত লাগে।
পার্বতী এখন আমার কাজে জোগান কেনে পুরোপুরি হাতই লাগায় বলতি পারেন।

বাঃ। আপনি মহাদেব, উনি পার্বতী?
এ তো হর-পার্বতী!

ইকেই বলে ভাগ্যি, পাশ থেকে বলে ওঠে পার্বতী। আরো বলে,
আমার কপালে জুটি গেল পাগলা ভোলা!
আমার দুই মেয়ে যখন পরপর হলে,
একজনের নাম রাখলেম সরস্বতী,
আরেকজনের নাম রাখলেম লক্ষ্মী।
আমরা তো আর নেখাপড়া জানিনে।
লক্ষ্মী হল মা দুগ্গার বড় মেয়ে,
ছোট মেয়ে সরস্বতী।
ভুল করে আমাদের বড়টার নাম
হয়ে গেল সরস্বতী
আর ছোটটার নাম হয়ে গেল লক্ষ্মী।

ওরা কি করে?

পার্বতী বলে চলে, ওরা লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ,
কালী, মনসা ঠাকুর বেচে।
আমাদের কাজে হাত লাগায়।
এসব ঠাকুর ছোটো ছোটো বানালিও চলে।
ফি বছর আমরা চলে আসি এই ফুটপাথে।
এই তো আমার মেয়ে লক্ষ্মী, সরস্বতী।
এরা আলাদা দোকান করেছে।
ওরা বেচবে পঁয়তাল্লিশটি সরস্বতী।
আমি আর উনি মিলে বেচবো পাঁচটা।

সরস্বতী বলে, আজ রাতভর আমরা সরস্বতী বেচবো।
সব পতিমা বিক্রি করে পুঁজির টাকা উঠবে কি না জানিনা!
বড় মূর্তি আমরা বানাতে পারি না।
অনেক টাকা লাগে।
এক লরি মাটির দাম চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা।এও সেই ডায়মন্ড হারবার থেকে আনতে হয়।
এ মাটিকে বলে ঠাকুরের মাটি।
আর এখান থেকে গঙ্গার মাটি এক-এক বস্তা কিনতে লাগে তিরিশ টাকা।
জানেন তো, প্রতি বছরই শেষ রাতের দিকে
খুব কম দামে আমাদের মা সরস্বতীকে বেচে দিতে হয়। কারণ এই পতিমাতো আর ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবো না।
ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া!সেও এক বিশাল খরচ!
আর মানুষও চালাক কম নয়!
ইচ্ছে করেই জানবুঝ ওরা বেশি রাত করে আসে।জানে, নিরুপায় অসহায় আমরা!
আমাদের যে বেচতেই হবে,বেচতেই হয়।
পেট আর পয়সা,বেচা আর বাঁচা—
একাকার হয়ে যায়!

মহাদেব বলে,
একক পিতিমেই আমরা বিক্রি করি।
লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, কালী, বিশ্বকর্মা, মা মনসা–এসবই একক পিতিমে।
এসব পিতিমে যেখেনে জনসমাবেশ বেশি,
যেখেনে বাজার গড়ে উঠেছে সেখেনে নিয়ে আমরা বসি।
দুগ্গা তো বিশাল পিতিমে! আগে বাবার সঙ্গে বানাতুম, এখন পারিনে—প্রচুর খরচ। আর আমরা তো ছোট শিল্পী,
বড় হতে পারলুম কই?

এই সরস্বতী, তুমি কোন ক্লাসে পড়?

আমি সেভেন পর্যন্ত পড়েছি, আর পড়িনা।
লক্ষ্মী এখন সিক্সে পড়ে। ওকে পড়িয়ে বড় করব ভাবছি।
আমরা কন্যাশ্রী,রূপশ্রীর টাকার কথা শুনেছি, তবে পাবো কিনা জানিনা।
তা লক্ষ্মীও এই মরশুমে আমাদের কাজে হাত লাগায়।

সরস্বতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে—
আপনারা পুজো করেন, ভক্তি করেন।
লাগ বিদ্যা লাগ, মোর কন্ঠে লাগ।
আমাদের পেট আছে, পুজো নেই।

সরস্বতীর তো শান্ত রূপ।
তার কন্ঠে কথা, গান দুটোই আছে জানি।
আমাদের জীবনের জন্য কোন গান, কথা অপেক্ষা করে আছে জানিনা!

আমাদের ভক্তি শুধু ভাতে।
আপনারা সরস্বতীকে মা বলে ডাকেন।

আমাদের ভক্তি নেই, শ্রদ্ধা নেই,ভয়ও নেই।
তবে ভয় নেই এই কথা বলতে এখন বড় ভয় লাগে। এখন অবস্থা খুব খারাপ। যদি ধর্ম,পুজো উঠে যায় তবে মূর্তি গড়ে,বেচে পেটের ভাত জোটাবো কেমন করে?
আমরা যে মা-কে বেচে খাই!