অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ
লকডাউন ও বীজপুর পটুয়াপাড়া

পর্ব-৩

 

লকডাউনের বাংলা ঘরবন্দী।
কেউ বলে অন্তরীণ, কেউ বলে নিভৃত জীবন। জীবন চরৈবেতি–সে তো চলমান। আমিও হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি সেই গলি। মনে মনে বলি এই গলি তো বহু চেনা গলি। হালিশহর ঘোষাল পাড়া।

সন্দীপ পাল প্রতিমা গড়েন এখানে। বিশাল সাদা পলিথিনের চালার নিচে তৈরি হচ্ছে উমা–দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি। ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে,সেই স্বচ্ছ সাদা পলিথিনের উপর। হাওয়ায় নড়ছে চড়ছে পলিথিন শিট। ‌

সন্দীপ পালের বাবা শান্তি পাল। এখন নেই। মাটির জগত থেকে মহাজাগতিকে চলে গেছেন। স্টুডিওতে টাঙানো আছে তার ছবি। প্রায় ২৬ বছর আগে জানতে চেয়েছিলাম, শান্তি দা, এখানে কেমন করে তৈরি হয় মা? সে তো গিরিবালা। কৈলাসে থাকে। সেখান থেকে মর্তে আসে। তা তোমরা মর্তে মা-কে বানাও, সে তো পর্বত কন্যা– পার্বতী। তাহলে কি করে মা কৈলাস থেকে এলো?
শান্তি দা পোড়খাওয়া শিল্পী। শিল্পীর প্রজ্ঞাই আলাদা। শান্তিদার পাল্টা জবাব, আমিতো গিরিবালা বা পার্বতী বানাই না। আমি বানাই ঘরের মেয়ে, উমা। আমাদের ঘরের মেয়ে ,ঘরেই থাকে, আমাদের কাছেই আসে।তোমরা যাকে বশো দুর্গা-দুর্গতিনাশিনী।আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি।

আমার এই গল্পগাছা মন দিয়ে শোনে সন্দীপ। শান্তিদার উত্তরপুরুষ। আমার দিকে তাকিয়ে বাবার দুই ফুট বাই এক ফুট প্রতিকৃতির দিকে হাতজোড় করে প্রণাম করে। আমায় বলে, আমার বাবা এমন ছিল?

সন্দীপের এবার ভাল করে মুখ ফোটে। বলে, এবার কোন থিমের কাজ নেই একচালার ছোট প্রতিমার চাহিদা এবার বেশি। করোনা কাল ছোট বাজেটের পুজো। সবাই বলে, বলুন পুজো না হলে ভালো লাগে! তাই নিরুপায় হয়ে পুজো করছি। নটা বানিয়েছি দুর্গা। নটাই বায়না হয়ে গিয়েছে। সন্দীপকে বলি,আপনি প্রতিমা গড়ছেন এমন একটা ছবি তুলি? তিনি বাধা দেন, না না এখনো তেমন শিল্পী হতে পারিনি যে, ছবি তুলবো আর মানুষ দেখবে! আরে মা বানানো কি সহজ? এ যে দেখি বাপের ধারা পেয়েছে। কি দ্রুত তার উত্তর নিজের সম্বন্ধে। বাপ কা বেটা।

সন্দীপের সঙ্গে কাজ করছে হারাধন পুরকাইত আর নির্মল পাল। সন্দীপ বলে, ওরাই আমার পেটের ভাত যোগায়। প্রতিমার সূচনার কাজ ওরাই করে। ওদের ছবি যদি নেন একটু দয়া করে, শিল্পীর বিনয়ে বলে সন্দীপ।

আমি ঘুরিফিরি কতরকম। শিল্পী দেখি। আর মানুষ বোঝার চেষ্টা করি, এরা সব মাটির মানুষ। এদের হাতেপায়ে মাটি। প্রতিমা গড়তে এঁটেল মাটি বিচুলি কুচি কুচি করে কেটে মিশেল দেয় পায়ে চেপে চেপে। সেই মাটি আবার হাতে তুলে নিয়ে মায়ের মুখ বানায়।

উমা যেন বলে ওঠে,পায়ে মাটি, হাতে মাটি খোকা আমার! কোত্থেকে এলি?