আজ আজ অগ্নিহোত্রী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলীর ১৩৫ তম জন্মদিন। সে বিষয়ে অবতকের একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ

মামা-ভাগ্নেঃ বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
তমাল সাহা

বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি দুই হাতে পিস্তল চালাতে তো পারতেনই,মোটর বাইক চালিয়েও পিস্তল চালাতে পারতেন। এমনই কিংবদন্তি। তার কোমরে, দুই হাঁটুতেও বাঁধা থাকতো পিস্তল।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের যে কোনো সশস্ত্র সংগ্রামে বিপিন গাঙ্গুলির পিস্তল সরবরাহ ছিল অনিবার্য। দশাসই মানুষ বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি। মুগুর ভাজা চেহারা। ওস্তাদ লাঠিয়াল। দক্ষ বক্সার। কলকাতা থেকে ব্যায়াম- শারীরিক কসরত শেখাতে আসতেন হালিশহরে। তখন রডা কোম্পানির পিস্তল লুঠ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। নায়ক কে? আমাদের হালিশহর তথা বীজপুরের ভূমিপুত্র বিপিন গাঙ্গুলি।
কি বুকটা একটু চওড়া হয়ে যাচ্ছে না?
১৯১৭ সালে বিপিন গাঙ্গুলী পিস্তল লুটের সঙ্গে বোমা ষতেও হাত পাকাতে চাইলেন। হালিশহরের নারায়ণ দাস বসু মল্লিকের বাড়ির ছাদে বসলো বারুদের আসর। তিনি নিজের হাতে গন্ধক ও মোমছাল মিশিয়ে দড়ির পর দড়ি পেঁচিয়ে নির্মাণ করেছিলেন স্বদেশী বোম। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম নায়ক গণেশ ঘোষের লেখা থেকে দেখতে পাচ্ছি ১৯২২ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে শ্রীমতী বাসন্তী দেবীর সভাপতিত্বে চট্টগ্রামে নিখিল বঙ্গ রাজনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার কদিন আগে মহানায়ক বিপিন গাঙ্গলি এক সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম পল্টনের মাঠে গণেশ ঘোষ অম্বিকা চক্রবর্তী নির্মল সেন অনন্ত সিং সহ নয়জনকে আমাদের নৈহাটির বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা আনন্দ মঠ থেকে উদ্ধৃতি উচ্চারণ করে আশীর্বাদ করেন। আরো জানা যায় বিপিন গাঙ্গুলি শিক্ষকের ছদ্মবেশে তারই বন্ধু-প্রতিম বিপ্লবী শিক্ষক নিবারণ ঘটক ষকে নিয়ে ছাত্র কাজীরুল ইসলামকে বিপ্লবের দীক্ষাদানে অগ্রণী হয়েছিলেন। বিপ্লবী বিপিন গাঙ্গুলি গার্ডেনরিচ- বেলেঘাটা স্বদেশী ডাকাতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।সেটা ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫ ।আর ১৯১৮ সালের আগস্টে ঐতিহাসিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিপিন গাঙ্গুলী এই ঐতিহাসিক মাউজার পিস্তল লুটে।এর এক অংশ চলে গিয়েছিল বিপ্লব মন্ত্রে দীক্ষিতা দুকড়ি বালার সেই গ্রামের বাড়িতে। তাকেও অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন গাঙ্গুলি। রাষ্ট্রবিপ্লবের পরিকল্পনা, ১৯১৫ বিষয়ে সরকারি গোপন দলিলে লেখা হয়েছিল যে এম এন রায় যার আসল নাম নরেন্দ্র ভট্টাচার্য তিনি এবং বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

রডা কোম্পানির সমস্ত পিস্তলই যেন তাঁর দখলে ছিল। ভারতে সশস্ত্র আন্দোলনে বিশ্বাসী সমস্ত দলেই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি এই পিস্তল। স্লোগান উঠেছিল, বিপিন-দার কাছে যাও, পিস্তল লাও। তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল রিভলবার মাস্টার।

আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তৈরি হয়েছিল আগুনখোর উপন্যাস ‘পথের দাবী’। কি প্রসঙ্গে এই দুই নেতার সম্পর্ক? একজন আগুনে বই লেখে, অন্যজন অগ্নিস্রাবী বন্দুক লুঠ করে।

কথায় বলে মামা-ভাগ্নে যেখানে, বিপদ নাই সেখানে। বিপিন গাঙ্গুলি এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দুজন মামা ভাগ্নে। প্রখ্যাত লেখক উপেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি, নিশ্চিত হালিশহরের মানুষ। তিনি ছিলেন বিপিন গাঙ্গুলির জ্যাঠতুতো ভাই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন উপেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির ভাগ্নে। মানে দাঁড়ালো বিপিন গাঙ্গুলিরও ভাগ্নে। বিপিন গাঙ্গুলি বয়সে ছোট হওয়ায় শরৎচন্দ্রকে মামা বলে ডাকতেন। বোঝা গেল কি কিছু? একজনার বই থেকে আগুন বেরোচ্ছে, অন্যজনের পিস্তল থেকে আগুন বেরোচ্ছে।

এখন আমরা ঊনপাঁজুরে মানুষ। এই যে বাতাস এখন আমাদের গায়ে পেটে করে নিয়ে যাচ্ছে রুচিশীলতার বিষ সেই দেশের জল মাটি মানুষ ও তার চেতনাকে বিষয় করেই লেখা হয়েছিল ভারতের মুক্তি আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ‌ বিপ্লবীরা হাতে তুলে নিচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। ব্যাগে করে পাচার করা হচ্ছে দড়ি বাঁধা বারুদের স্তূপ। বইয়ের ভেতরে খাপ করে লুকানো পিস্তল। দারুণ সব রক্ত ছোটা তুফান উত্তেজনা!

১৯২৬ সাল। উপন্যাসটি লিখলেন ডাকাবুকো বোহেমিয়ান মানুষটি। পড়ে গেলেন রাজদ্রোহে, নিষেধাজ্ঞা জারী হল উপন্যাসটির বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক কথাকার শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে নিজের হাতে উপন্যাসটি পড়তে দিলেন। সহযোগিতা চাইলেন তাঁর কাছে।

রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, বইখানি উত্তেজক।
ব্যথিত, ক্ষুব্ধ হলেন রাজনৈতিক ভাষ্যকার সময়ের সব্যসাচী। তিনি আরেক সব্যসাচীর উদ্দেশ্যে লিখলেন, কোন বিস্মৃত অতীতে তোমার জন্যই তো প্রথম শৃঙ্খল রচিত হইয়াছিল , কারাগার তো শুধু তোমাকে মনে করিয়াই প্রথম নির্মিত হইয়াছিল………. পথের দাবী সেই রক্তের উজানটানা উপন্যাস।

উপন্যাসটি লেখার অনুপ্রেরণা কোথায় পেয়েছিলে তুমি শরৎচন্দ্র? পেয়েছো তুমি আমাদের বীজপুরের হালিশহরেই।

টেররিস্ট মুভমেন্টের ভিত্তিমূলক এই উপন্যাসের মূল সূত্র মহান বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি। আমাদের শ্লাঘা আকাশছোঁয়া। কেননা বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি আমাদের হালিশহরের শিবের গলির মানুষ।

বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি বিভিন্ন সময়ে দেবানন্দপুর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজের বাড়িতে পলাতক জীবন যাপনও করেছিলেন। সব্যসাচীর চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিপিন গাঙ্গুলির জীবনের ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে। ‌শরৎ চাটুজ্জে তাঁর ভাগ্নের ভারতবর্ষব্যাপী এই বিস্ময়কর কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।‌ শরৎচন্দ্রকে দেশবন্ধুর বাড়িতে বহু বিপ্লবী সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বিপিন গাঙ্গুলি। বিপিন গাঙ্গুলির ছদ্মবেশ, ছদ্মনাম, যত্রতত্র গতিবিধি, পিস্তল সংগ্রহ, দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগের আর শরৎ চাটুজ্জে সৃষ্ট সব্যসাচী চরিত্র
একাকার।

শরৎচন্দ্র সেসময় হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি। বিপিন গাঙ্গুলি তখন হাওড়া জেলার শিবপুর, সালকিয়া, ডোমজুড়, আন্দুল, বাগনানে দাপিয়ে সংগঠন করে চলেছেন। সেই সময় শরৎচন্দ্র তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। অর্থ সাহায্য ও আত্মগোপনের ব্যবস্থা করেছেন।

শরৎচন্দ্র বিপিনবিহারী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘কত বলি বিপিন আমার বাড়িতে এসে মাঝে মাঝে দু চারদিন থাকো,একটু ভালো খাও, ভালো বিছানায় শোও, একটু আদর যত্ন গ্রহণ কর–তা ওর সময় হয় না। সময় হবে কোথা থেকে, দেশের চিন্তা ছাড়া ওর কি আর চিন্তা আছে? কিছুই নেই।’ (শরৎচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনঃ শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায়)।

অনেকে মনে করেন সব্যসাচীর চরিত্রের সঙ্গে রাসবিহারী বসুরও সাযুজ্য রয়েছে। সে ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়।যাই হোক বিপ্লবী শ্যামাধন সেনগুপ্ত বিপিন গাঙ্গুলিকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, সব্যসাচী চরিত্র কার আদলে বলে আপনার মনে হয়? বিপিন গাঙ্গুলির বিনীত জবাব, তুমি যা ভাবছ তা নয়।

এসব কথা লিখেও সুখ আছে। এ হচ্ছে পথের দাবী লেখকের কথা আর অস্ত্রবাদী বিপিন গাঙ্গুলির কথা, মামা ভাগ্নের কথা— আমাদের পাড়ার কথা।