মাধ্যমিক মারাইছে
তমাল সাহা

গত ৩ জুন ২০২২ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েইছে। আজ সকালে চুল কাটাতে গিয়েছি শ্রী সেলুনে। কবরস্থান মাঠের এক চিলতে জমি দখল করে সেলুন বানিয়েছে চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে দুই ভাই– ‌মদন শীল ও খগেন শীল।

ওরা কোনোদিন উদ্বাস্তু ছিল। বাঁচার তাগিদে এদেশে এসেছে। নক্কাছক্কা করে রাজনীতির দালালদের ধরে ভোটার কার্ড রেশন কার্ড আধার কার্ড বানিয়ে এ দেশের নাগরিক হয়ে গিয়েছে। মাস পাঁচেক হল এক অ্যাপ্রেন্টিস মানে শিক্ষানবীশ নাপিত নিয়েছে তারা তাদের দোকানে। তার নাম সুশীল বেইজ। সে শুধু দাড়ি কাটে, এটা দিয়েই তার শিক্ষা শুরু।

আমরা লাইনে বসে আছি। মহীতোষ বাবু বলে উঠলেন, আরে জানেন মাস্টারমশাই! এবার মাধ্যমিকে ৮৬.৬০ শতাংশ উত্তীর্ণ হয়েছে। মেধার চাষবাস, শুনলে আশ্চর্য হয়ে যাবেন। প্রথম থেকে দশে রয়েছে ১১৪ জন। মাস্টারমশাই বলেন, এতো ভাল কথা, মেধার চাষবাস হচ্ছে।

এতক্ষণ ধরে এতো কথা শুনে ফোঁস করে উঠল সুশীল,ওই সেই অ্যাপ্রেন্টিস নাপিত। সে উত্তেজিত। বলে ফেললো, আমাদের শিক্ষামন্ত্রী কি বলছেন জানেন?

মাস্টারমশাই বলেন, কি বলেছেন?

মাধ্যমিকের গাড় মাইরছে বুট্যে! মন্ত্রী বইলছ্যে, মেধাবীর যিন খিয়াল থাকে ওই চাষাটোর কথা যে উর ভাত জোগাইন দিছে। উর মনে থাকে যিন উ চামারের কথা যে উর জুতা জোগাইন দিছে। উর মুনে থাকে যিন উ দর্জিটোর কথা যে উর পিরান বানাইন দিছে। ইমন দরদভরা কথাটো কুনোদিন আপনি কুনো মন্ত্রীর মুখে শুইনেছেন? আইচ্ছা ইসব ছেলেপুলাগুলান তো অনেক বড় হুইবে,ইত্ত মেধাবি,ইদের কামকাইজ মিলবে বুটে? আপনি কি বলেন মাস্টরমশাই?

সুবোধ তো খুর থামিয়ে রেখেছে খরিদ্দারের গালে। গালের সাবান শুকিয়ে গেছে। আবার সাবানের ব্রাশ বোলাতে বোলাতে বলে, ই যে শতশত লিখাপড়া জানা ছেলেপুলাগুলান পাস কইরে যোগ্যতা থাইকলেও চাকরির লিগ্গে উ কইলকাত্যা মাসের পর মাস বইস্যে আছে ধর্ণা দিয়ে,কোর্ট সাফাসাফা বইল্যে দিছে ৫০০ কোটি টাকা খাইয়ে লিছে উ শালারা, শিক্ষা দপ্তর, ই অসহায়দেরদের কামটাই বরবাদ করে দিছে। ইসব কথা তো শিক্ষামন্ত্রী বুলেন নাই।

মু সুশীলও ইবার মাধ্যমিক পরীক্ষা ষটো দিতে পাইরতম বটে। বাঁকুড়া থিকে চইলে আইলুম। শালো! সংসার চলে না। বাবাটো বুড়া হইয়ে গিছে। এখন আর রোইদে পুড়ে জলে ভিজে রাজমিস্ত্রির কাম কইরতে পারে না। মাটো বাড়ি বাড়ি রাইন্ধবার কাজ করে। দু দুটা বুন গন্ধ মাইখ্যে বিহানবেলা কুথায় চইলে রায়,সেই রাইতে ফিরে,গা দিয়ে ঘামের গন্ধ। জানিনা কি করে? করোনা তো মুরও একবার হইছিলো বটে। ধুর,সংসার টো চলে না,তো স্কুলছুট হইয়ে চইলে আসলুম কইলকাত্তা। দেখা হইয়ে গিল মহীতোষ বাবুর সাথে। কথায় কথায় উনি বইলেল, চল মুর গাঁয়ে,মুর সাথে কাম শিখবি। চইলে আইলম।

তো ইবার দেখি বিবাক পাশ। মুনে দুঃখ হইল, পরীক্ষাতে পাশ হয়ে যাইতুম বটে। মুর বন্ধুর বহিন আছে না,লক্ষ্মী ওরাও। উর পড়াটোও বন্ধ হইয়ে গেল। উদের সংসারও আর চলে না। উরও ইস্কুল ছুট হইয়ে গেল। উর বিহা হইয়ে গেল।

আরে উ যে ১১৪ জন মাথাউঁচু ছেলেপুলের কথা বইলেন না কাগজে দিখবেন টিবি দিখবেন,উদের মা-বাবার আজ কত গইব্য বটে। সবাই বুলছে উনার ছেলেপুলে কেউ ডাক্তার হুবে,কেউ ইঞ্জিনিয়ার হুবেক,কেউ বুলছে না– মাস্টর হুবেক। তো মু বলি ইত্ত হাসপাতাল,ইত্ত সেক্টর কুথায়? তো মাস্টরও যদি হয় ইত্ত ইস্কুল কুথায়? ইস্কুল তো হুইল বটে কিন্তু মাস্টর হুইবার লিগে নিয়োগের কামে দুর্নীতি উঠাবে কোন শালো?

মাস্টরমুশাই আপনি তো ই গঙ্গার পারে থাকেন। কত্ত জুটমিল বন্ধ, ইসব মজুরের ছেলেপুলেরা কত্ত ইস্কুল ছুট,আপনি জানেন?

আপনি বুলেন তো মাস্টরমশাই,আপনি কি কুনোদিন বুলছেন মুর ছেলে চাষী হবেক,নয় তো চামার হুবেক, নয়তো দর্জি হুবেক? মুর মত নাপিতের কাম কুরবেক? বলেন নাই তো!আপনিও তো মাস্টরমুশাই বড় বড় আশা লিয়ে বইসে আছেন।

তবে মুরা পেটে খিদে লিয়ে কুথা যাই?