প্রবীণ নবীন চেনা অচেনার শহরের মধ্যে উত্তর কলকাতার সাতনম্বর রামধন মিত্র লেনের হলুদ রঙের বাড়িটা যেন আস্ত একটা ইতিহাস। কোনো একসময় এই বাড়িরই অলিন্দে ঘুরে বেড়াতো বলিষ্ঠ এক কণ্ঠস্বর, যাঁর নামটা জুড়েই শুধু রয়েছে বাঙালির যাবতীয় ভালোলাগা চিরন্তন আবেগ তিনি বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। যাঁর আকণ্ঠ ধ্বনিতে “অশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির ” সুর শুনে আজও বাঙালির ঘুম ভাঙে ভোর তিনটে পঞ্চাশে। শারদপ্রাতে শিউলি ঝরা মৃদুগন্ধে বীরেন বাবুর গলায় মহিষাসুরমর্দিনীর সুর আর “বাজলো তোমার আলোর বেনু “বলে দেয় আর বেশি দেরি নেই “মা আসছেন।” মহালয়ার ভোরে ঘরের কোনে পড়ে থাকা ধুলো ঝাড়া রেডিওটার পাল্লা ঐ দিন বেশভারী, টিভির পর্দার কম্পিটিশনএ সেদিন সে একেবারে প্রথম সারিতে।

অশ্বিনের শারদিয়ার প্রাক্কালে সময় কখনো কখনো থমকে যায় আহিরীটোলার রামধন মিত্র লেনের এই বাড়িটাতে, এখান থেকেই বীরেন্দ্র ভদ্র যেতেন কারস্টোন প্লেসের আকাশবাণী ভবনে। পুরোনো দিন গুলোতে নামি দামী ব্যাক্তিবর্গ, সংবাদ মাধমের ভিড় উপচে পড়তো এই বাড়িরই বৈঠক খানায়।

একসময় রেলের চাকরি ছেড়ে রেডিওতে যোগদান করেছিলেন বীরেন্দ্রবাবু।
1932 সালের ষষ্ঠীর ভোরবেলায় পঙ্কজমল্লিক, বাণীকুমার, বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য হরিশ্চন্দ্র বাণী, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যাক্তি মিলে ঠিক করলেন মহিষাসুরমর্দিনীর রিহার্সাল পর্ব রেডিওতে সম্প্রচার করবেন। ষ্টুডিওয় রেকর্ডিং সিস্টেমের চল আসেনি তখনো কাজেই সমস্ত অনুষ্ঠানই প্রচারিত হতো লাইভে। ষ্টুডিওর সেই মহিষাসুরমর্দিনী এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠলো, উৎসাহিত হয়ে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন পরের বছরেই অর্থাৎ 1933 সালে মহিষাসুরমর্দিনী চন্ডীপাঠ হিসাবে নতুনভাবে উপস্থাপনা করা হবে। এইভাবেই চললো কয়েকটা বছর, এবার মহিষাসুরমর্দিনীর চন্ডীপাঠ রেকর্ডিং এর মাধ্যমে সম্প্রচার করাহবে এমনটাই ভাবলো আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ, শুরু হলো তার পথ চলা। বছরের পর বছর ধরে মহালয়ার ভোরের মহিষাসুরমর্দিনীর আগমনী চন্ডীপাঠ শিহরিত করে বাঙালির মনকে। শারদ আনন্দের স্রোত আছড়ে পড়ে রেডিও অফিসে, বঙ্গদেশের কোনায় কোনায় , কুমোরটুলির উঠোনে। কিন্তু স্রোত যে ছন্নছাড়া,তাই কোনো একদিন আকাশবাণীর দপ্তরেও হঠাৎই বইতে লাগলো অজানা এক ছন্নছাড়া স্রোতের ধারা।
সালটা 1976 আকাশবাণীভবন হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁদের চিরাচরিত মহিষাসুরমর্দিনীর নবরূপ দেবীদুর্গতিহারিণী পাঠ করবেন আমাদের মহানায়ক। আয়োজনের কোনো ত্রুটিই ছিল না বলা চলে, কে নেই সেখানে হেমন্তকুমার,শৈলেন মুখোপাধ্যায়, উত্তম কুমার লতা মঙ্গেশকর, বসন্ত চৌধুরী আরো অনেক শিল্পীর সমাগম। যেমন ভাবা তেমনি কাজ যথারীতি ঐ বছর চন্ডীপাঠ থেকে বাদ পড়লেন বীরেন্দ্র ভদ্র, প্রথামেনে চলে আসা এতো বছরের ইতিহাসে হঠাৎ একটা ছেদ পড়ে গেল। সাথে সাথেই চারিদিকের বইতে থাকলো সমালোচনার ঝড়, একসাথে অনেক কিছু সামলাতে হলো আকাশবাণীর দপ্তরকে, উত্তেজিত জনতা ভাঙচুর করলো রেডিও অফিস,চললো বিক্ষোভ। সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নে রীতিমতো হিমশিম খেলো রেডিও কর্তৃপক্ষ। সে বছরে অনেকে মনে করলেন মহালয়ার পূণ্যভোর তাহলে এবার কলুষিত হলো, কাজেই বিপদ আসন্ন। অতঃপর তরীঘরী ঐ বছরই ষষ্ঠীর ভোরে আকাশবাণী থেকে বীরেন্দ্র কৃষ্ণের চন্ডীপাঠ পুনরায় সম্প্রচার করা হলো আগের মতো। যাবতীয় দুঃখ যন্ত্রনা ভুলে গিয়ে বীরেন্দ্র বাবুও আবার লেগে পড়লেন ওনার নিজের কাজে। তাঁর কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী আবারও সেজে উঠলো নিজেররূপে।

শারদ পুরুষ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ আগমনীর বার্তা শুনিয়ে যে রেডিও কে এতটা কাল জনপ্রিয় করেতুলেছিলেন, দুঃখের বিষয় সেই রেডিও থেকেই তিনি অবসর নেবার পর কোনো পেনসেন পাননি। চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে তাঁর দিনগুলো কেটেছিল মহাভারতের ভাষ্যকার হিসাবে। ক্যারিয়ারের সায়ান্যে ক্রমশ স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পরায় অবশেষে তিনি সেই কাজ ও ছেড়ে ছিলেন। চরম অর্থাভাব থেকে মুক্তি পেতে পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে বেড়াতেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণভদ্র তথা বিরূপাক্ষ। আকাশবাণীর প্রডিউসারের তকমা লাগেনি বীরেন্দ্র বাবুর কপালে, জীবনের শেষেও পাননি কোনো সরকারী স্বীকৃতি, পদ্মশ্রী বা পদ্মভূষণ সম্মান আসেনি ওনার ঘরে। কয়েকটা উত্তরীয় আর কিছু চাদর ছাড়া গোটা জীবনে তেমন কিছুই পাননি তিনি। ওনার কাছের মানুষদের থেকেই জানা যায় হৃদয়জোরা একরাশ অভিমান নিয়েই বীরেন্দ্র ভদ্র কাটিয়ে ছিলেন তাঁর শেষজীবনটা, তাই আজও হয়তো আকাশবাণীর অন্দরে বেজে ওঠে তাঁর সেই অতৃপ্ত কণ্ঠস্বর। ক্যারিয়ারের শুরুতে বীরেন্দ্র বাবু বেতার জগতের উত্থানের সাক্ষী ছিলেন তেমনি আবার বেতারশব্দের বেড়াজাল থেকে মানুষকে সরে গিয়ে টিভির জগতে গা ভাসাতেও দেখেছেন তিনি। আজকাল টিভির দুনিয়ার রমরমায় পাশে স্মৃতির আড়ালে একাকীই থেকে গিয়েছে বাঙালির হৃদয়ে শারদীয়ার আগমনের ঢেউ তোলা বিরূপাক্ষের উচ্চাঙ্গ কণ্ঠস্বর। তাই মহালয়ার দিনটিতে আলোর বেনুর মতো প্রবাহিত হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কে বেতারে আটকে রেখেছে ঐ একটাই কণ্ঠস্বর, বিশ্বজুড়ে বাঙালি বছরের পর বছর ধরে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সেই কণ্ঠ শোনার জন্য আজও বেতারে কান পেতে থাকে।
সুমনা আদক —-