মহান নাট্যকার উৎপল দত্ত কাঁচরাপাড়ায়ঃ জন্মদিনে শ্রদ্ধা
তমাল সাহা

দ্রষ্টা কার্ল মার্ক্স ‘দাস ক্যাপিটাল’ লিখেই ক্ষান্ত ছিলেন না। তাকে কবিতাও লিখতে হয়েছে।
একজন লেনিন শুধু রাজনৈতিক সত্তায় লেনিন হতে পারতেন না, তাকে বেঠোফেনের সিম্ফনিও শুনতে হয়।ম্যাক্সিম গোর্কির সঙ্গে বন্ধুত্বও করতে হয়।
মাও সে তুং শুধু তাত্ত্বিক প্রজ্ঞায় মাও সে তুং নন। তাই তাকে গাইতে হয় দীর্ঘ পদযাত্রার গান আর লুসুনকে পাশে রাখতে হয়।

১৯৬৬। রাজনৈতিক চেতনার নতুন স্লোগান– কংগ্রেস হটাও, দেশ বাঁচাও। কেরোসিন কৌটো হাতে নুরুল গুলি খেল বারাসতের স্বরূপনগরে। সেই ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন। আনন্দ হাইতের দেহ পড়ে রইল কৃষ্ণনগরের রাস্তায়। নৈহাটির জোয়ান কিশোর রেল ব্রিজের নীচে পুলিশের বেয়নেটের সামনে দাঁড়ালো বুক চিতিয়ে। ছবি তুলে রাখলেন দৈনিক বসুমতীর ফটোগ্রাফার– আমাদের কাঁচরাপাড়ার রেলওয়ে কোয়ার্টারের বাসিন্দা বিনয়দা, বিনয় মুখোপাধ্যায়।
সেই লড়াকু সময়ে সেই কাগজের সম্পাদক ছিলেন শাণিত কলম ধারক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়।

সময় তখন বুকে ডিনামাইট বেঁধে দৌড়োচ্ছে।
১৯৬৭ র নির্বাচন। সাংস্কৃতিক কর্মীরা নাটক বাঁধছেন। অভিনয় করছেন। শুধু নেতাগিরি আর ভাষণেই যদি কেল্লা ফতে হবে তবে ব্রেখটকে নাটক লিখতে হতো না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে কলম ধরতে হতো না। সুকান্তকে কমিউনিস্ট কবির শিরোপা পরতে হত না। আর মাণিক বাড়ুজ্জেকে সাম্যবাদী শিবিরে পা ফেলতে হতো না।
অথচ রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন তাদের চেয়ে বড় মাতব্বর আর নেই।

কুড়ি বছরের কংগ্রেসী শাসনের ঝুঁটি ধরে মাথা নাড়িয়ে দিয়েছিল ‘দিন বদলের পালা’ নামের এই
একমাত্র নাটকটি।
কাঁচরাপাড়া, কবরখানা ময়দান। বিশাল মঞ্চ। কাতারে কাতারে মানুষ। তারা আর ভাষণ শুনতে চায় না। দেখতে চায় আর অনুভব করতে চায় নাটক। নির্দেশনা, অভিনয়ে উৎপল দত্ত। ‘দিন বদলের পালা’ অভিনীত হল। উৎপল দত্তর বাক-বৈদগ্ধ্য অভিনয়, বিশ্লেষণ সে এক অবিস্মরণীয় ব্যাপার!

পাল্টে গেল দিন। সেবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস প্রথম ঠোক্কর খেল। বীজপুর বিধানসভায়ও হেরে গেল কংগ্রেস।

এখন নির্বাচনে নাটক লাগেনা। চাটক বা চাটুকার লাগে। বেগড়বাই করেছো তো ফাটকে আটক। সংস্কৃতির বদলে দুষ্কৃতির প্রাধান্য। ভোটে জেতার বড় নাটক এখন রিগিং।
সেই নাটকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল। নাটকের মাঝখানে লোডশেডিং হয়ে যায়। তখন লোডশেডিং-এর কোনো ব্যাপার ছিল না। দাপট ছিল না কোনোমতেই। লোডশেডিং বলে শব্দটি চালুই ছিল না। হঠাৎ করে সেই নাটক চলাকালীন অর্ধপথে কিছুক্ষণ বন্ধ রাখতে হয় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকার জন্য। অনেকে মনে করেন, অনেকে মনে করেন নয়, উৎপল দত্ত নিজেই মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দেন– এই হচ্ছে কংগ্রেস! তারা নাটকও করতে দেবে না। এইজন্য এখানে সাময়িক কালের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে আমার ধারণা। এখন রাজনৈতিক ভাবে বামপন্থীদের দিন সমাসন্ন। সুতরাং তাকে যতটা সম্ভব বাধা দেওয়া যায়।

দামামা ওই বাজে,দিন বদলের পালা /এল ঐ ঝড়ো যুগের মাঝে।

কল্লোল, তীর, টোটা,লাল দুর্গ, টিনের তলোয়ার, ব্যারিকেডের নাট্যকার নির্দেশক কোনোদিন এসেছিল কাঁচরাপাড়ায়। সৌভাগ্যবশত এই উল্লেখ্য নাটক সমূহ ছাড়াও এই নাট্যকারের অন্যান্য নাটক এই কলমচির দর্শনজনিত অভিজ্ঞতা রয়েছে।

ব্যারিকেড নাটকটির প্রথম অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলামন্দিরে ২৫ ডিসেম্বর,১৯৭২। দ্বিপ্রাহরিক শো-তে এই নাটকটি দেখবার পর কল্লোল নাটকের র্্যাটট্রে ও ব্যারিকেড নাটকের ব্রুনো-র
সঙ্গে দেখা করলো এই কলমচি গ্রিনরুমে। রাশভারী মানুষটির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এই থিয়েটারওয়ালাই সদর্পে একদিন বলিনি যে সদর্পে বলেছিলেন, আপনাকে বেছে নিতে হবে হয় নকশালবাড়ি, না হয় বেশ্যাবাড়ি।

এই নাট্যকারেরই ‘কল্লোল’ নাটকের বিজ্ঞাপন বুর্জোয়া কাগজ থেকে শুরু করে কোনো বামপন্থী দেশহিতৈষী পত্রিকাও ছাপতে অস্বীকার করেছিল।
‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ নাটক অভিনয় করতে গিয়ে কংগ্রেসী মস্তানদের হাতে প্রহৃত হয়েছিলেন উৎপল দত্ত।’টিনের তলোয়ার’ নাটককে অশ্লীল আখ্যা দিয়ে সাদা পোশাকের পুলিশ দিয়ে নাট্যকর্মীদের রবীন্দ্রসদন থেকে বার করে দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত তার ‘তীর’ নাটকটির মহলা দেখে গিয়েছেন সেই সময়ের বিতর্কিত বামপন্থী তাত্ত্বিক নকশালবাড়ি আন্দোলনের মুখ্য কারিগর চারু মজুমদার।

কাঁচরাপাড়ায় এরপর কংগ্রেস সমর্থক দ্বারা পরিচালিত ভারতী সংঘের আয়োজনে সার্কাস ময়দানে উৎপল দত্তের নাটক ‘লেনিন কোথায়?’ এবং অন্য একটি সংস্থার আয়োজনে মান্ধারী স্কুল সংলগ্ন আর্য সমিতির মাঠে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। ‘লেনিন
কোথায়?’ নাটকটি চলার মধ্য মুহূর্তে দর্শক আসন থেকে উঠে পড়েন সে সময়ের কংগ্রেস ব্যক্তিত্ব এবং এক সময়ের পৌরপ্রধান বিজয়বসন্ত নন্দী। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এই নাটক আনলো কে ও কেন? সেইসময় বামপন্থীদের অজ্ঞাতবাস চলছে। আরে সেই বাহাত্তরের সন্ত্রাস কাল। নাটকটি শেষ হয়েছিল মঞ্চের ফ্রন্ট কার্টেন জুড়ে লাল পতাকা টেনে দিয়ে।
কাঁচরাপাড়ার নাট্যজীবনে এভাবে জড়িয়ে আছেন উৎপল দত্ত।

ভোট নামক পালা পার্বণের আগে তার সেই নাটক ‘দিন বদলের পালা’ তাকে কী তোর একবারও মনে পড়ে কাঁচরাপাড়া?

আর এই নাট্যকারের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে এবং মুক্তির দাবিতে পথে হেঁটেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। হীরক রাজার দেশে,জয়বাবা ফেলুনাথ, আগন্তুক, ভুবন সোম চলচ্চিত্র– উৎপল দত্ত ছাড়া ভাবা যায়!