মহানবমীঃ অবতকের বিশেষ প্রতিবেদন

মহানবমীর সকালঃ আজ সকালে রূপার কাছে 

তমাল সাহা

রূপা একটি মেয়ে। আজ নবমীর সকাল। তখন পৌনে নটা বাজে। আমি রূপার কাছে চলে যাই। খোলসা করেই বলি। খালধার পার। দুটি জেলার সংযোগস্থল। গাছপালা, বহতা খাল একটা আরণ্যক সৌন্দর্য রচনা করেছিল এক সময়ে। এখনো সেই বনজ ঘ্রাণ আছে। সেখানে রূপা থাকে।

রূপার সঙ্গে পরিচয় বহু দিনের। ট্রেন যাতায়াতে। গল্পের মতো বানানো নয়, যে তার বাবা নেই, মা বিধবা। বাড়ি বাড়ি কাজ করে। এ সেসব গল্প নয়। রূপা মাধ্যমিক পাশ। তার আরো দুটো ভাই আছে। তারা ফুটে মানে ফুটপাতে ব্যবসা করে। ওরা একজন সেভেন, একজন এইট পর্যন্ত পড়েছে। এখন বড় হয়ে গিয়েছে। ওদের ব্যবসার পুঁজি জোগাড় করে দিয়েছে রূপা। আসল মূলধন রূপা-ই।

রূপার বয়স কত? এখন বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ হবে। রূপাদের ঘরবাড়ি আগের চেয়ে অনেক পাল্টেছে। দরমার বেড়া, মাটির মেঝে, মাথায় টালির ছাদ আর নেই। আবাস যোজনার টাকা ওরা পেয়েছে। রূপার কারণে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের কাছে আমাকে একবার যেতে হয়েছিল। ওই আশ্রয়, মাথা গুঁজবার ঠাঁইয়ের কারণে। চেয়ারম্যান সাহেব সহযোগিতা করেছিলেন। রূপার সঙ্গে আমার যোগাযোগ পাড়ার লোক জানে।

আজ গিয়ে দেখি রূপা শুয়ে আছে। ওই গালে মুখে চটকানো রংয়ের প্রলেপ তখনো লেগে আছে। কাল ছিল মহাষ্টমীর মহান রাত। শরীর আর কত ধকল সইতে পারে!

প্রথম প্রথম ও বেশ্যা কাকে বলে, কেন বলে– এসব জানতে চেয়েছিল।

আমি বলি, তোমরা বেশ্যা নও রূপাজীবা, শ্রমিষ্ঠা নারী। বোধ করি বৈশ্য শব্দ থেকে বেশ্যা শব্দটি এসেছে। বৈশ্যদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। বিক্রিত পণ্যকে বলা হয় বেশ্যা।আমি মনে করি তোমরা বিভিন্ন বেশে নিজেকে পণ্য করে দোকান সাজাও তাই হয়তো বলা হয় বেশ্যা। মানে বেশ শব্দ থেকে বেশ্যা।

রূপা আজ বলে, তুমি এসে ভালো করেছো। কাল খুব ধকল গিয়েছে। আজ নবমী দুপুরের মধ্যেই বেরুতে হবে।

আজই তো আসলে পুজোর শেষ দিন। কাল তো বিসর্জন!

রূপা ওই যে পশ এলাকা বলে সেখানে দাঁড়ায়। এটা রেগে লাইট এরিয়া নয়। ধনী বাবুরা ওদের কিনে নিয়ে বড় বড় হোটেলে ওঠে। তিন-চারটে গ্রাহক হলেই রূপার চলে যায়। কাল অষ্টমী ছিল। সন্ধিপুজোর রাত। বলির বাজনা বাজছিল। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। এক বাবু নিজের গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে গেছে বাড়িতে।

সেই কলকাতা থেকে খালধারের এই বাড়িতে।

দুর্গা পূজায় মৃন্ময়ী প্রতিমা গড়ে তুলতে রূপার মতো চিন্ময়ী বেশ্যাদের ঘরের মাটি লাগে। প্রতিমা গড়তে লাগে বিভিন্ন রকমের মাটি। সেই মাটির সঙ্গে এই দেহজীবিনীদের বাড়ির মাটির মিশেল দিতেই হবে। ঘরের বাইরের মাটিতে পুণ্যবানেরা(!) পা রাখেন। রূপারা নিজের দেহে পুণ্যবানদের সমস্ত কলুষ ধারণ করে নিজেদের কলুষিত করে। যে নারী কলুষ ধারণ করে সে তো নীলকন্ঠী! রূপারা ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। রূপাজীবারা নিজের নারীত্বকে সাজায়। পণ্যের মতো দেখায়। ঘরের প্রবেশদ্বারের মাটিতে পুণ্যের পা আর পাপের পা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

মা তো সর্বজয়া, সর্বগরলধারিণী। বেশ্যাদের জীবনের গরল দুর্গা প্রতিমার গড়ার মাটিতে মিশে যায়। পটুয়ার হাতে তখন মাতৃপ্রতিমা সালঙ্কারা রাজেশ্বরী হয়ে ওঠে, নির্মাণশৈলীতে প্রাণময় হয়ে ওঠে রুপাদেরই অন্যরূপ। বাতাসে মন্ত্র ধ্বনিত হয়— রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি….

বারবাড়িতে মন্ত্রের তালে তালে রূপারা শরীরের ঐশ্বর্য সমর্পণ করে কোন জয় কোন যশ লাভ করতে থাকে আমরা কি বুঝি?