এগরার বাজি কারখানায় বিস্ফোরণঃ ১৬ মে,২০১৩
অবতকের বিশেষ প্রতিবেদন

ভানুর বাজির কারখানা ও আমি
তমাল সাহা

আমি সত্তর দশকে রাস্তায় পড়ে থাকা বুলেটের খোল দেখেছি। পিচের রাস্তায় জমে থাকা থকথকে রক্ত দেখেছি। শুকিয়ে রক্তের কৃষ্ণময়তা আমার দেখা। সাধারণ রক্তক্ষরণ আর হত্যার রক্তপাত আমার জানা। কবরখানা মাঠে ওই ছোট্ট মাংসের দোকানের দেয়ালে একটি যুবকের দেহ ঠেকিয়ে ওসি সাহেবকে সরাসরি গুলি করতে আমি দেখেছি। গান্ধী মোড়ে পালবাড়ির দেয়ালে স্প্লিন্টারের দাগ, বিস্ফোরণে নিহতের ছিন্ন ভিন্ন মাংস সেঁটে আছে তাও আমার দেখা। আমি চিরকালই চক্ষুষ্মান বালক।

ভানুর বাজির কারখানা। বয়সের প্রান্তিক বেলায় নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করি। সঞ্চয় কতদিন থাকবে বলতে পারি না। কারণ সূর্য পশ্চিম দিকের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে। নটবরঘাট ছুঁয়ে যাওয়া ভাগীরথীর জলে ডুব দেবে বলে।
আমি চলে এলাম এগরার সাহাড়া পঞ্চায়েতের খাদিকুল গ্রামে।
বিস্ফোরণের শব্দটা কেমন ছিল? কেউ বলে আকাশ ফাটানো, কেউ বলে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। টাটকা পোড়ামাংস ও ক্রিয়াশীল বারুদের অবিমিশ্র গন্ধে এক নয়া অনুভূতি পেলাম। তখনো আগুন জ্বলছে সঙ্গে বাজির শব্দ হচ্ছে। আকাশ সাদা ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে।এক বিশেষজ্ঞ জানালো, এটা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ধোঁয়া। কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়েছিলাম কোনোদিন মনে পড়ে গেল। জীবনের কেমিস্ট্রি আর মিস্ট্রি মিলেমিশে একাকার। চারিদিকে তাকালাম। গাঁয়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য বজায় আছে। গাছপালা, মাঠ, খেতের আল, পুকুর সব আছে।

বিস্তীর্ণ মাঠের উপর কঙ্কালসার বাজির কারখানা। আমি তখন রাধা! আমার চোখ কৃষ্ণময়। সর্বত্র কালো অঙ্গার দেখি। উড়ে গেছে ছাদ। বাকি সব পিলার পুড়ে গেছে। একটি পিলার কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের চালা কোথায় গিয়ে পড়েছে কেউ জানে না। ছাইয়ের স্তূপ। খোঁজ চলছে– দেহ, মৃতদেহ চাই। ঘুরতে থাকি, দেখতে থাকি। রাস্তায় পড়ে আছে ঝলসানো দেহ। ঢেকে দেবার চেষ্টা চলছে। দেহ পড়ে আছে মাঠের পাশে, পুকুরের ধারে। পুকুরে ভাসছে দুটি সোমত্ত শরীর। পুকুরের জল বারুদের আবরণ। তাতে সূর্যের আলো পড়েছে। কারখানা থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে পড়ে আছে কয়েকটি নারীদেহ।

বাজির কারখানায় যারা কাজ করে তাদের কি বলে? মজুর- মজুরানি না বারুদ বালক, বারুদ বালিকা? দেয়ালের ওই ধারে কালো ভুতুড়ে শরীর নিয়ে চারটি পোড়া সাইকেল পড়ে আছে। একটি কিম্ভূতকিমাকার স্কুটি।
বারুদ ঘরে কি কেউ পাখি পোষে? খাঁচার মধ্যে তিনটি পাখি বোধ করি ধ্বংসের আওয়াজেই অজ্ঞানে হয়ে মারা গেছে। ঠোঁট লাল। গলায় কালো দাগ।তারা কি মৃত্যুকালে কৃষ্ণ নাম জপেছিল?
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়!
বাতাসে স্বর আওয়াজ হয়ে ভেসে ওঠে ….কটা মড়া পাওয়া গেল গো? কটা? বুঝতে পারি না পড়শি মানুষগুলো মৃতের সংখ্যা জানতে চাইছে আগ্রহে না উদ্বেগে! লাশের সংখ্যা কমলে ভালো, না বাড়লে ভালো– আমি কিছু জানি না।
উঁকি মেরে পাশের ঘরে দেখি রান্নার আয়োজন হয়েছিল বুঝি। একটা থালায় জলে ভাসছে সজনে ডাঁটার টুকরো, উচ্ছের গোল গোল ফালি। উনুনে চাপানো হাঁড়ি।
কার খিদে পেয়েছিল গো!
দেখি আর শিখি। শালা আগুন! কংক্রিটের পিলার সাইকেল লোহার খাঁচা পাখি সব খায়!

তোমরা মানে বিজ্ঞ পরিবেশবিদরা বলো, পলিথিন হটাও! মানুষ বাঁচাও!
তোমরা পলিথিনের গুরুত্ব আমার এইটা বোঝো! পলিথিন কত লোকের মাথার ছাউনি যোগায়, জানো? লাশ যে পলিথিন ভালোবাসে এটা কি জানো? দেখি পুলিশের লোকেরা পলিথিন সিট পেতে তার উপর মৃতদেহগুলি শুইয়ে রাখছে। এত ঝলসানো মুখ– কে মাধবী কে মালতী কে বকুল কে মিনতি কে কবিতা কে জানে? এর মধ্যে কার মা কোনটা চেনা যায়?
কাঁদতে কাঁদতে এক কিশোর বলছিল, আমার মা কোথায়? আমার মা কোথায়? সে তো সেই সকালে কাজ করতে বেরিয়েছিল।
আমি আর কি বলি? ১৪ই মে বিশ্ব মা দিবস গিয়েছে। দুনিয়ার সব মাই-ই তোর মা!

ভানুর বাজির কারখানা– বিস্তৃত খোলা মাঠে বাড়ি থেকে কম বেশি ১০০ মিটার দূরে। ভানুর ভালো নাম কৃষ্ণপদ। কৃষ্ণপদর ক্ষমতা আছে বটে! কারখানায় সহজে যেতে মাঠের উপর দিয়ে ঢালাই রাস্তা চলে গেছে। লাইট পোস্ট বসিয়ে বসিয়ে অবৈধ কারখানায় তড়িৎবাবুরা বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দিয়েছেন। ভানু এখন হাপিশ! চম্পট দিয়েছে। কোথায় কে জানে? ভানুর যে বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল না তা কি করে বলি!
সে কি জানতো কোনদিনও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে! তাইতো পুকুরের পাশে কারখানা করেছিল। তাতে আগুনপোড়া দেহও ভেসে উঠেছে।

বাজি কারখানা করতে আসল মূলধন শাসকের রাজনৈতিক মদত আর তার জন্য তো নিজের গাঁটের কিছু অর্থ খরচ করতেই হবে। না হলে কাটমানির দুনিয়া চলবে কি করে? না হলে নেতাদের আমদানি কি করে হয় আর কি করে হবে বউয়ের জামদানি শাড়ি?

বাজি শব্দটি যারা বারুদঘরে কাজ করে তাদের কাছে ক্লিশে হয়ে গিয়েছে। তারা জানে জীবন বাজি রেখে বাজি কারখানায় যেতে হয়। পেটের কাছে বাজি তুচ্ছ। বাংলা ভাষা কেন মহান তা একটু খুলেই বলি। প বর্গের বর্ণগুলো মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে।
প-য়ে পেট, ফ-য়ে ফতুর, ব-য়ে বিশ্ববাংলা বোমা বারুদ বিস্ফোরণ, ভ-য়ে ভাত এবং ম-য়ে মৃত্যু!