এপার ওপার ওপার বাংলার বর্ষিষ্ঠ কবি সাংবাদিক কৃষ্ণ ধর চলে গেলেন। তিনি জন্মেছিলেন ওপারে ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জের কমলপুর গ্রামে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮সালে। চলে গেলেন ১২ অক্টোবর ২০২২ বুধবার এপার বাংলা থেকে।

বেইজ্জত অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে 

তমাল সাহা 

কবিরা কি কি হয় কে জানে? কবিরা মেঘ পাখি হয়ে উড়াল দিতে পারে। কবিরা ঝড়ের সংলাপ জানে আর জানে বৃষ্টি আনার স্তব। সবই করে কবিরা মাটির উপরে দাঁড়িয়ে মানুষকে কাছে এবং পাশে রেখে।

কত কবিদের নাম শুনেছি, পাঠ্যপুস্তক এমনকি কাব্যগ্রন্থেও তাদের কবিতা পড়েছি। কিন্তু একগাদা কবিদের প্রত্যক্ষ করেছি, ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে ভিড় করে তাদের কবিতা পড়তে দেখেছি। একবারে কেউ কোনোদিন এতো কবি দেখেছে নাকি? সেখানে ভিড় করেছে সুভাষ মুখোপাধ্যায় রাম বসু গোলাম কুদ্দুস মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় দিনেশ দাস অমিতাভ দাশগুপ্ত মণীন্দ্র রায় সত্য গুহ আশিস সান্যাল তরুণ সান্যাল কৃষ্ণ ধর— এই সব কবিদের মুখগুলি এখন ভেসে ওঠে চোখের তারায় ।এই কবির দঙ্গল কোথায় ভিড়েছিল? যেখানে ক্রিকেট খেলা হয় সেই নন্দন কাননে,ইডেনে। কেন? সাত দিনব্যাপী যুব উৎসবের আয়োজন যুব মেলায়। সে এক বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যুব সঙ্ঘের সেই গুরুদাস দাশগুপ্তের নেতৃত্বে চলতো সেই যুব উৎসব।রাশিয়ার যুব সম্মেলনকে সম্মানিকতা দিতে এই যুব উৎসব।

কবিরা সাংবাদিক অথবা সাংবাদিকরা কবি, কবিরা রাজনৈতিক বা রাজনীতিবিহীন কবিতা– কবিতা নিয়ে চাষবাসের উপকরণ ও অনুষঙ্গ এসব তখন আমার মাথায় চারিয়ে যায়।

সুভাষ মুখুজ্জে, গোলাম কুদ্দুসরা এক হাতে সাংবাদিকতা অন্য হাতে কবিতা লিখে বেড়িয়েছে। কৃষ্ণ ধর আগে সাংবাদিক পরে কবি আমি জানিনা। তবে চুটিয়ে কাজ করেছে সংবাদপত্রে যুগান্তরের সহ-সম্পাদক আর আশির দশকে দৈনিক বসুমতীতে সম্পাদনার মূল দায়িত্ব নিয়ে।

সংবাদ মূলত কাব্য, কাব্য মূলত সংবাদ, পর্যবেক্ষণই কবিতা পর্যবেক্ষণই সংবাদ।

কৃষ্ণ ধরের কাব্য পরিমাপের দাঁড়িপাল্লা আমার হাতে নেই। রাজনৈতিক বস্তুবাদী চেতনা না থাকলে ব্যক্তি মানুষ কবি লেখক সাহিত্যিক হয়ে উঠতে পারে না– তার লিখন এবং সাহিত্যিক কার্যক্রম আমাকে এসবই শেখায়‌। আন্তর্জাতিক পর্যটন সেরেছে সে। বিশ্বকে দেখেছে। কবিতা, কাব্য নাটক, প্রবন্ধ, সাংবাদিকতার চতুরালি সম্বন্ধেও সে লিখেছে। তার আত্মজীবনী ‘আট দশক সাতকাহন’ না পড়েই আমি তাকে নিয়ে লিখে ফেলি…

কৃষ্ণপক্ষ শাসিত সময়ে তুমি অঙ্গীকার করেছিলে লিখে যাবে মাটি আর মানুষের ইশতেহার।

তুমি বলো,

হে সময় হে সন্ধিক্ষণ, প্রিয় বাক্ কথা রাখো।

এ জন্মের নায়ক তুমি

কালের নিসর্গ দৃশ্য দেখবে বলে উচ্চারণ করো, হাটব থামবো না।

আমরা বলি শাসক তোর হাতে রক্ত!

আর তুমি বলো,

আমার হাতে রক্ত!

এ কার রক্ত দেখাও তুমি আমাদের?

কবিতা থেকে

ক্রমাগত সংলাপের দিকে চলে যাও,

তুমি লিখে ফেলো একের পর এক কাব্য নাটক।

বধ্যভূমিতে বাসর সাজিয়ে অন্ধকারে জুঁই ফুলের গন্ধ পাও

বন জ্যোৎস্নায় কাদের পদশব্দ শোনা যায়!

বিকেলের বারান্দা পেরিয়ে কেয়া ফুলের গন্ধ শুঁকে প্রহত প্রহরে তুমি বলো

আমি নচিকেতা, আমি অভিমন্যু

কালের রাখাল তুমি ভিয়েতনাম

আবার হতে চাও সিন্ধুপারের পাখি।

তুমি জানো সমবেত হাততালির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাবে একদিন ভোরের মানুষেরা।

তুমি কী নিজেই অশ্বমেধের ঘোড়া হতে চাও!

তুমি কি এখন মারহাট্টা ডিচের ওপারে দাঁড়িয়ে আছো?

দ্রুতগামী তুমি ছুটতে ছুটতে বলে যাও

কবে পিল পিল করে বেরিয়ে পড়বে সংশপ্তক অক্ষৌহিণী সেনা।

শব্দহীন শোভাযাত্রার অপূর্ব রাজনৈতিক বিন্যাসে তুমি প্রশস্ত করে আমাদের জানিয়ে দাও, এ অশ্বমেধের ঘোড়া বলিপ্রদত্ত নয়

‘হাজার হাজার বছর ধরে মার খেতে খেতে

এ মাটি এখন পাথর

এ বড় কঠিন শহর মহারাজ

দ্যাখো কী বেইজ্জত অশ্বমেধের ঘোড়া

ময়দানে গিয়ে মুখ দেয় অর্বাচীন ঘাসে।’

তারপর?

তারপর আর কি হবে বলো নি তুমি।

তারপর পেটভর্তি শ্বাসবায়ু নিয়ে আবার ছুটবে পৃথিবীর ময়দানে মানুষের জয়গানে…