চলে গেলেন চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক মৃণাল সেন যখন আলোড়ন তুলেছেন চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় সে সময়েই তিনি সিনেমাতে তুলে ধরলেন বাঙালিয়ানার এক অন্য ঘরানা

অবতকের বিশেষ প্রতিবেদন 

বুকে নিয়ে গীতাঞ্জলি, শরীর ঢেকে রক্ত পতাকায় কে যায়!

তমাল সাহা

চরৈবেতি এই জীবন

জীবনপুরের পথিক রে ভাই!জীবন দেখি,দেখাই তো আমার কাজ। আর এইসব জীবন থেকে কত কিছু শিখি। জীবন দেখি আর জীবন লিখি। কলমে কিছুটা তো সাহিত্য ছিল!এতদিন কাগজের সাথে নিবের ঘর্ষণে কিছু শব্দ উচ্চারিত হয়েছিল। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করি কত জীবনের,কত মানুষের মুখোমুখি হই। ‌আর সেইসব সংলাপ লিখে চলি।

চাওয়া-পাওয়া খুব সহজ শব্দবন্ধ। ছোটবেলা মানে ফোর-ফাইভে যখন পড়ি এই শব্দবন্ধটি কানে ঢুকে যায়। ‌ স্মৃতিটুকু থাক। ওই বয়সে স্মৃতি বলতে কি বোঝায়? তা কি আমি জানি? সেই থেকে এই স্বরধ্বনিগুলি মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছিল। দাদা, দিদিরা এই শব্দবন্ধগুলি শুনিয়েছিল। তখন তো তাদের তারুণ্য। প্রেম ভালোবাসার কথা তারা জেনে গিয়েছে। সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল উত্তম-সুচিত্রা বা সুচিত্রা-উত্তম। এই শব্দ শোনার মধ্যে ওই যে বলেনা ভালোবাসা রোমান্স এসব লুকিয়েছিল তা তো পরে বুঝতে পারি। সুচিত্রা কে দেখলেই যেকোনো বয়সের ছেলেদের ভালো লেগে যায়। তেমন মেয়েদের কাছে উত্তম কুমার! বাব্বাহ!

এই চাওয়া-পাওয়া চলচ্চিত্রটি নির্মাণে তাঁর ভূমিকা ছিল। পরে জেনেছি এবং সিনেমাটি দেখেছি। যান্ত্রিক নামে সেই চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছিলেন তিনি।

তখন পলিটিক্স বোঝার বয়স হয়নি। পরে বুঝেছি পলিটিক্সটাও একটা রোমান্স। রোমান্স না থাকলে কিছুই হয় না। কারণ ইমোশান আর মোশন পাশাপাশি চলে। বেগ থাকলেই আবেগের কথা ওঠে। এত বড় সৌমিত্র অতটুকু মৌসুমীকে ভালোবেসে পরিণীতা হয়ে গেল! কী ভালো লেগেছিল অভিনয়!বা বালিকা বধূতে পায়ের উপর উঠে উচ্চতা বাড়িয়ে ওই যে অদৃশ্য চুমু খাওয়া — এই দৃশ্য নির্মাণও মাথায় এসেছিল তাঁর। এইসব দৃশ্য দেখিয়ে তিনি আমাদের দেখার অভীপ্সা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। শ্রীমান পৃথ্বীরাজ বইতে উৎপল দত্তকে দিয়ে অমন অভিনয় করানো,কার না ভালো লাগেবে! পলাতকে অনুপ কুমার যেন জীবনটাকে পাল্টে দিয়েছিল। নিমন্ত্রণ না দেখলে জীবন বোধ জাগে? সংসার সীমান্তে যখন দেখি তখন পুরোপুরি রাজনীতির আসরে নেমে পড়েছি। রাজনৈতিক ময়দানে থেকেই দেখে ফেললাম কুহেলী,ফুলেশ্বরী। আর দাদার কীর্তি সেই তাপস পাল উল্টো চরিত্রের হয়ে গেল সক্রিয় রাজনীতি করতে গিয়ে। তখন তাঁর কি অসভ্য অশ্লীল সংলাপ! সেসব শুনে

আজ কে তাপস পালকে মনে রাখবে? মহুয়া মৌসুমী দেবশ্রীরা পার্থ তাপসরা বলতে গেলে তাঁর হাতেই উঠে এসেছিল।

গণদেবতা তাঁর হাতে হয়ে উঠেছিল অপূর্ব নির্মাণ। ‌অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় সেই চরিত্র, তাঁকে দিয়ে তাঁর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অভিনয়টি করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। মহাজনী শোষণের চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলে অজিতেশ দামামা বাজিয়ে দিয়েছিল আমাদের বুকের মধ্যে।

তো মানুষটি রাজনীতি মানে বাম রাজনীতি সচেতন তো বটেই সক্রিয়ও ছিলেন। ধীরে নিচুস্বরে খোলাখুলি কথা বলতেন।

তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণে গ্ৰামীণ দৃশ্য, প্রকৃতির সৌন্দর্য্য আমাদের জীবনের শেকড়কে ভালবাসতে শিখিয়েছিল।

আমার কথার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, দেখো শুদ্ধ পরিবেশ পবিত্রতা লুকিয়ে আছে আমাদের গ্ৰামীণ জীবনে।

আর রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথকে এত ব্যবহার করেছিলেন তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে ভাবা যায়! চরণও ধরিতে দিও গো আমারে, বধূ কোন আলো লাগলো চোখে বা তুমি রবে নীরবে, চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে… কি অনুরণ তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আমাদের হৃদয়ে।

২০১৩ সাল,কল্যাণী বইমেলায় তাঁর সঙ্গে দেখা। আর খোলাখুলি কথা। তিনি আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এসেছিলেন বইমেলা উদ্বোধনে। সৌমিত্র নদীয়ার কৃষ্ণনগরের মানুষ। সুতরাং জেলা ভিত্তিক একটা টান তো থাকবেই,আবেগ তো থাকবেই। কল্যাণী নদীয়া জেলায়, কল্যাণী থেকে কৃষ্ণনগর আর কত দূর!

তিনি তখন মঞ্চের উপরে নয়,নীচে সামনের সারিতে বসে আছেন। আমি তো তখন সাংবাদিক তকমা পেয়ে গিয়েছি। সুতরাং, সাক্ষাৎকার যাকে বলে কথা বলতে অসুবিধা হলো না। ‌ আর মেলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার তো একটা হৃদ্যতা ছিল ফলে বাড়তি সুবিধেই পেয়ে গেলাম।

কথা শুরু হলো অন্যরকম ভাবে। আমি একটু বোকা বোকা ভাবে বলি। সিনেমার সঙ্গে বইমেলার সম্পর্কটা যদি একটু বলেন। আপনি সিনেমা জগতের লোক। বইমেলা কর্তৃপক্ষ আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি আমাকে বোধ হয় একটু বোধহীন ঠাওরালেন। তিনি আমার মুখের দিকে তাকালেন। বললেন, শুনুন। আমি সাহিত্য নির্ভরশীল সিনেমা করি। সাহিত্যের

উপর নির্ভর করে সিনেমা করলে সাহিত্যিকের লেখাটিও মানুষের কাছে পৌঁছয়,আমার নির্মাণের বিষয়টিকেও মানুষ সহজে বুঝতে পারে। বই পড়ে ভালো লাগলে সেটাই আমার বিষয় হয়। আমি হতাশাজনক

কোন সিনেমা করি না। ‌

আপনায সিনেমায় ভালোবাসা, সামাজিক দায়…

তিনি বলেন, ভালোবাসা ছাড়া জীবন চলে নাকি!মধ্যবিত্ত জীবন গ্রামীণ জীবন পিছিয়ে পড়া মানুষ শোষণের একটা দিক আমার সিনেমায় থাকে। ‌

আপনার সিনেমায় প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব মনোরম। ‌

—- হ্যাঁ, প্রকৃতি ছাড়া জীবন হয় না। জীবনে সারল্যও প্রয়োজন।

আমি বলি তা আমরা পরিণীতা বালিকা বধূ শ্রীমান পৃথ্বীরাজে দেখেছি। পলাতকে আবার অন্যরকম জীবন। গণদেবতা তো খুবই ভালো লেগেছিল। ‌

আমার দিকে তাকালেন। তিনি বলেন, সেখানে গ্রামীণ শোষণ রয়েছে। মহাজনের সুদের বিষয়টি রয়েছে। জনগণের জাগরণের ব্যাপার রয়েছে।

তাঁর মৃত্যু হল। তিনি চলে গেলেন। স্মৃতি ফিরে আসে।

জীবনপুরের পথিক রে ভাই কোন দেশেতেই সাকিন নাই…

গীতাঞ্জলি বুকে নিয়ে শরীর ঢেকে রক্ত পতাকায় কে যায়!